Total Pageviews

Feedjit Live

Tuesday, July 26, 2011

ক্ষমা দেবধর্ম

সৈয়দ আবুল মকসুদ
প্রাচ্যে সেই বৈদিক যুগেই ঋষিরা বলে গেছেন: ক্ষমা দেবধর্ম। দেবতারা চাইলে যে কাউকে ক্ষমা করে দিতে পারেন। মধ্যপ্রাচ্যে প্রবর্তিত ইসলামি ধর্মশাস্ত্রেও বলা হয়েছে: আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হও। আল্লাহর অসংখ্য গুণের মধ্যে একটি তাঁর ক্ষমাশীলতা। সাংঘাতিক পাপীতাপীও তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলে তিনি ক্ষমা করে দেন।
আমার এক পাঠিকা অনেকটা বিচলিতভাবে আমাকে অনুরোধ করেছেন: ‘ক্ষমা নিয়ে কিছু লিখুন তো!’ কিসের ক্ষমা, কাকে ক্ষমা, কী কারণে ক্ষমা—তা তিনি কিছু বলেননি। রাজনীতির ক্ষমা, না সাহিত্যের ক্ষমা; অর্থনীতির অর্থাৎ শেয়ারবাজারের অপরাধীদের ক্ষমা, না টেন্ডার-সংক্রান্ত মারামারির ক্ষমা; টাকা পাচারকারীদের ক্ষমা, না ছাত্রী ধর্ষণের অপরাধীকে ক্ষমা; কূটনীতিকদের অপকর্মের ক্ষমা, নাকি খুনের মামলার দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ওরফে নেতাকে ক্ষমা—তা তিনি পরিষ্কার করে বলেননি।
আইন-আদালতের জগতে ক্ষমা বলতে কী বোঝায় তা আমার জানার কথা নয়। আইন সাহিত্য আমার অপঠিত। মাস তিনেক ঘোরাঘুরি করেছিলাম আলীম আল রাজীর পাঠশালায়। আইনের ক-খ শুরু করেছিলাম, ক্ষমার অধ্যায় পর্যন্ত যাওয়ার আগেই ইস্তফা দিই। তবে আইন সাহিত্যে না হলেও বাংলা সাহিত্যে কোথায় ক্ষমা চাওয়াচাওয়ি আছে, তা কিছু জানা আছে।
আমাদের উপজেলার কর্মকর্তাদেরও গুরুদেব, যেন তারা সবাই শান্তিনিকেতনের তিরিশের দশকের ছাত্র, ম্যালা বিষয়ে লিখে গেছেন। নানা রকম ক্ষমার কথাও আছে তাঁর রচনায়। তবে খুনখারাবির আসামিকে ক্ষমা করার কথা তিনি বলে যাননি। তাঁর চিত্রাঙ্গদা গীতিনাট্যে চিত্রাঙ্গদাকে অর্জুনের উদ্দেশে বলতে শুনি:
আমি তোমায় করিব নিবেদন
আমার হূদয় প্রাণ মন।
শিল্পা শেঠি বা মাধুরী দীক্ষিতের মতো সুন্দরী চিত্রাঙ্গদার ওই প্রস্তাব আমাদের মতো মানুষকে দিলে বলতাম: অতি উত্তম। কিন্তু অর্জুন অন্য রকম। তিনি বলেছেন:
ক্ষমা করো আমায়, আমায়—
বরণযোগ্য নহি বরাঙ্গনে—
ব্রহ্মচারী ব্রতধারী।
গুরুদেবের পরিশোধ নাট্যগীতি আপনারা অনেকেই শুনেছেন। বজ্রসেন বলছেন:
কাঁদিতে হবে রে, রে পাপিষ্ঠা
জীবনে পাবি না শান্তি।
প্রত্যুত্তরে শ্যামা বলছেন:
ক্ষমা করো নাথ, ক্ষমা করো
এ পাপের যে অভিসম্পাত
হোক বিধাতার হাতে নিদারুণতর
তুমি ক্ষমা করো।
ক্ষমা সম্পর্কে গুরুদেবের আরও কথাবার্তা আছে। তাঁর চণ্ডালিকা-য় আনন্দ বলছে:
জল দাও, আমায় জল দাও।
প্রকৃতি তার জবাবে বলছে:
ক্ষমা করো প্রভু, ক্ষমা করো মোরে
আমি চণ্ডালের কন্যা
মোর কূপের বারি অশূচি।
দুনিয়াতে নানা রকমের ক্ষমা চাওয়া আর ক্ষমা করা আছে। ইচ্ছা করে কোনো তরুণীর গায়ে একটু ঘষা দিয়ে তাকে বলতে পারেন: ক্ষমা করুন। এ ক্ষেত্রে যদি ক্ষমা আপনি পান, তা নিয়ে পত্রপত্রিকা লেখালেখি করবে না। গোটা কয়েক মার্ডার করে আদালতের রায়ে যদি আপনি প্রাণদণ্ড পান এবং সেই প্রাণদণ্ড যদি কলমের এক খোঁচায় মওকুফ হয়, তখন কাগজগুলো কিছু লিখুক বা না লিখুক ক্ষমাকারীর বিবেক কী বলছে, তা জানার আগ্রহ যে কারও হতে পারে।
ক্ষমা বলতে রবীন্দ্রনাথের নায়ক-নায়িকারা যা বোঝে, আমাদের রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমা তা নয়। আমরা এমন এক রাষ্ট্রে বাস করছি যেখানে অপরাধী হলেই হবে না, তার দলীয় পরিচয়টিই প্রধান। একেক আমলে একেক ধর্মীয় পরিচয় গুরুত্বপূর্ণ। তার বাড়ি কোন জেলায়। এসব পরিচয় যদি ঠিকঠাক থাকে তা হলে কেউ ছাত্রী ধর্ষণ ও সাত খুন করেও পার পেয়ে যাবে। দলীয় ও ধর্মীয় পরিচয় যদি মিলে যায়, সোনায় সোহাগা। ওই ধর্ষকের ব্যাপারে মানবাধিকারকর্মীরা টুঁ-শব্দটিও করবেন না—রাস্তার মধ্যে আদম বন্ধন যতই হোক তার শাস্তির দাবিতে। সাংগঠনিক, দলীয় ও ধর্মীয়—এই তিন পরিচয় যদি খাপে খাপে মিলে যায়, তা হলে কোনো কূটনীতিকের কুচ পরোয়া নেই। তিনি তাঁর গাড়িতে অন্য রাষ্ট্রের পতাকা ওড়াতে পারেন, বন্ধুরাষ্ট্রের কূটনীতিকের সুন্দরী স্ত্রীকে বিরক্ত করতে পারেন, কারও হোন্ডার পেছনে বসে শুঁড়িখানায় বা অন্য কোনো আলয়ে যেতে পারেন, চাঁদার খাতা নিয়ে ঘুরে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা রোজগার করতে পারেন। তাঁর সম্পর্কে কাগজের লোকেরা অভিযোগ করলে, তাঁর মন্ত্রী বলবেন, ছিঃ, ওসব বলতে নেই, এখন আমরা সেক্যুলার। ক্ষমা তাঁকে করব না তো কাকে করব?
অপরাধীর ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নেই। সত্য ও ন্যায়বিচার ব্যক্তি ও ধর্মনিরপেক্ষ। অপরাধী যত প্রিয়জনই হোক তাকে ক্ষমা করা যায় না। উপমহাদেশের মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে মহাত্মা গান্ধীর পত্নী কস্তুরবা গান্ধীর ত্যাগ বিরাট। একবার তিনি ভুলবশত আশ্রমের সম্ভবত মাত্র চারটি টাকা নিজের প্রয়োজনে খরচ করেছিলেন। হিসাব না মেলায়, গান্ধীজি তদন্ত করে দেখলেন ও-টাকা কস্তুরবা ব্যয় করেছেন। ক্ষুব্ধ গান্ধী তাঁর অনুসারীদের সামনেই স্ত্রীকে ভৎর্ সনা করে বললেন, এই টাকা জনগণের। তুমি তা ব্যয় করেছ। এটাকে বলে চুরি। তোমার নামে পুলিশের কাছে চুরির অভিযোগে কেস করা যায়।
গান্ধীজি তাঁর সর্বত্যাগী পত্নীকেও ক্ষমা করেননি। এর নাম নৈতিকতা।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।  প্রথম আলো

0 comments:

Post a Comment

Twitter Delicious Facebook Digg Stumbleupon Favorites More