প্রতিবছর শান্তিতে নোবেল পুরস্কারটি আসে নরওয়ে থেকে। বিশ্বজুড়ে হানাহানির এই সময়ে শান্তির দেশই ছিল নরডিক এ দেশটি। কিন্তু গত শুক্রবার জোড়া সন্ত্রাসী হামলায় রক্তাক্ত হলো দেশটির মাটি। রাজধানী অসলোতে বোমা বিস্ফোরণে নিহত হয়েছে সাতজন। ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরসহ কয়েকটি সরকারি ভবন। এর কিছুক্ষণ পর রাজধানীর দক্ষিণে একটি দ্বীপে দেশের ক্ষমতাসীন দলের যুব সংগঠনের সম্মেলনে এক বন্দুকধারীর গুলিতে নিহত হয়েছে ৮৫ জন। এই বন্দুকধারীই অসলোতে বোমা হামলার সঙ্গে জড়িত বলে ধারণা করছে পুলিশ। খবর এএফপি, রয়টার্স, বিবিসির।
অসলোতে বোমা: অসলোতে বিস্ফোরণ ঘটে স্থানীয় সময় বেলা তিনটার দিকে। শহরের মধ্যাঞ্চলে প্রচণ্ড শব্দে ওই বিস্ফোরণ ঘটে। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর, অর্থ মন্ত্রণালয়, তেল মন্ত্রণালয় ও দেশের প্রধান ট্যাবলয়েড পত্রিকা ভিজের প্রধান কার্যালয় ওই এলাকায় অবস্থিত। বিস্ফোরণের সময় প্রধানমন্ত্রী জেনস স্টলটেনবার্গ নিজের কার্যালয়ে ছিলেন না।
স্টেট সেক্রেটারি ক্রিস্টিন অ্যামুন্ডসেন বলেন, শুক্রবার ছিল সরকারি ছুটির দিন। কাজেই অন্য দিনের মতো ভবনগুলোতে সরকারি কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন না। তার পরও ওই ভবনগুলোতে প্রতিদিন শত শত মানুষ থাকে।
বিস্ফোরণে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের ১৭ তলা ভবনসহ পাশের বহুতল সরকারি ভবনগুলোর জানালার কাচসহ কাঠামো ভেঙেচুরে রাস্তায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে। কোনো কোনো ভবনের নিচের তলাও বিধ্বস্ত হয়। বিস্ফোরণে ভিজের প্রধান কার্যালয়ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
পুলিশ জানায়, এটি গাড়িবোমা হামলা ছিল বলে তাদের মনে হয়েছে, তবে তারা নিশ্চিত নয়। গতকাল পর্যন্ত কোনো পক্ষ ওই বিস্ফোরণের দায় স্বীকার করেনি।
ন্যাটোর সদস্য দেশ নরওয়েতে এর আগে কখনো এ ধরনের হামলার ঘটনা ঘটেনি। তবে আফগান যুদ্ধে জড়িত হওয়ার পর থেকে কখনো কখনো আল-কায়েদার হুমকির মুখে পড়েছে দেশটি।
বন্দুকধারীর গুলি: রাজধানী থেকে মাত্র ১৭ মাইল দক্ষিণের ছোট্ট দ্বীপ উটোয়া। পাইন বনে ঢাকা দ্বীপটি লম্বায় মাত্র আধা কিলোমিটারের মতো। শুক্রবার দেশের ক্ষমতাসীন দল লেবার পার্টির যুব সংগঠনের গ্রীষ্মকালীন সম্মেলন হচ্ছিল সেখানে। সারা দেশ থেকে সেখানে জড়ো হয়েছিলেন সংগঠনের এক হাজারের মতো নেতা-কর্মী ও সমর্থক। তাঁদের বেশির ভাগই তরুণ। প্রধানমন্ত্রী জেনস স্টলটেনবার্গের গতকাল শনিবার ওই সম্মেলনে যোগ দেওয়ার কথা ছিল।
শুক্রবার বিকেলে অসলোতে বিস্ফোরণের ঘণ্টা দুয়েক পর উটোয়ায় হামলা চালায় একজন বন্দুকধারী। পুলিশবেশী ওই হামলাকারী নির্বিচারে গুলি চালাতে শুরু করে।
গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, বন্দুকধারীর কাছে একটি হাতবন্দুক, একটি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ও একটি শটগান ছিল।
এনআরকে টেলিভিশনের একজন সাংবাদিক বলেন, পুলিশের পোশাক পরা ওই বন্দুকধারী ফেরিতে করে মূল ভূখণ্ড থেকে দ্বীপটিতে পৌঁছায়। সে জানায়, অসলোতে বিস্ফোরণের কারণে সে তল্লাশি করতে সেখানে এসেছে। এরপর সে লোকজনকে এক জায়গায় জড়ো হতে বলে। লোকজন জড়ো হওয়ার পরই সে গুলি চালাতে শুরু করে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বন্দুকধারী ওই লোক বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে থাকে। সম্মেলনে অংশ নেওয়া অনেকে তখন প্রাণভয়ে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি শুরু করেন। অনেকে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
উটোয়া থেকে মাত্র কয়েক শ মিটার দূরে অবস্থিত টেরিফোর্ড এলাকা। সেখানকার বাসিন্দা এনিটা লেইন বলেন, ‘দেখলাম, মানুষ দল বেঁধে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। ৫০ জনের মতো সাঁতরে তীরে ওঠে। এরপর সবাই কান্নায় ভেঙে পড়ে। সবার চোখে-মুখে রাজ্যের আতঙ্ক। এদের বেশির ভাগের বয়স ১৪ থেকে ১৯ বছরের মধ্যে।’
বন্দুকধারীর ওই নারকীয় তাণ্ডব থেকে বেঁচে গেছেন জর্গান বেনোনি। তিনি বলেন, ‘দেখলাম, টা...টা...টা...শব্দে একটার পর একটা ঝড়ের মতো গুলি হচ্ছে। পাখির মতো পড়ে যাচ্ছে মানুষ। আমিও সঙ্গে সঙ্গে বসে পড়লাম। নিজেকে লুকানোর চেষ্টা করলাম কয়েকটি পাথরের আড়ালে। সেখান থেকেই একনজর দেখলাম হামলাকারীকে, মাত্র ২০-৩০ মিটার দূরে।’
বেনোনি আরও বলেন, ‘একটু দূরে তীরে দেখলাম, কয়েকটি নৌকা ভেড়ানো আছে; কিন্তু আমি সাহস পেলাম না ওই নৌকায় উঠতে। পরে ঝাঁপিয়ে পড়লাম পানিতে।’
হানা নামের ১৬ বছরের এক কিশোর যোগ দিয়েছিল ওই সম্মেলনে। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সে বলে, ‘একটু আগে অসলোর বিস্ফোরণের খবরটি আমরা জানতে পারি। এক পাশে দাঁড়িয়ে কয়েকজন মিলে তা নিয়ে কথা বলছিলাম। দেখলাম, একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে এক পুলিশ। হঠাৎ করে ওই পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি করতে শুরু করল। যে যেভাবে পারল দৌড় দিল সৈকতের দিকে। পানিতে পড়ে সাঁতরাতে শুরু করলাম।’
এভাবে চলতে থাকে গুলির বৃষ্টি আর প্রাণভয়ে মানুষের ছোটাছুটি। কেউ ঝাঁপিয়ে পড়ে পানিতে, কেউ নিজেকে লুকানোর চেষ্টা করে ঝোপ-জঙ্গলের মধ্যে। অবশেষে জীবিত অবস্থায় আটক করা হয় বন্দুকধারীকে।
থেমে যায় তাণ্ডব। ততক্ষণে রক্তে লাল হয়ে গেছে ছোট্ট সুন্দর সবুজ দ্বীপটি। গতকাল দুপুর পর্যন্ত ৮৫ জনের মৃত্যু নিশ্চিত করে পুলিশ।
কে এই হামলাকারী: দীর্ঘ হত্যাযজ্ঞের পর ঘটনাস্থল থেকেই বন্দুকধারীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। নাম অ্যান্ডারস বেহরিং ব্রেইভিক। বয়স ৩২ বছর। বেশ লম্বা গড়নের এই যুবক নরওয়েরই নাগরিক। ডানপন্থী সংগঠনের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল বলে জানিয়েছে পুলিশ। তা ছাড়া তিনি ইন্টারনেটেও ডানপন্থী ও মুসলিমবিরোধী মত প্রকাশ করেছিলেন।
একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, বন্দুকধারীকে ঘটনাস্থলেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরে তাঁকে অসলোতে পুলিশ স্টেশনে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘এটা অদ্ভুত ব্যাপার যে বন্দুকধারী আত্মহত্যা করেনি। এ ধরনের ঘটনায় হামলাকারী সাধারণত আত্মহত্যা করে থাকে।’
অপর একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের কাছে তাঁর সম্পর্কে বেশি কিছু তথ্য নেই। তাঁর নিজের ওয়েবসাইট ঘেঁটে মনে হচ্ছে, তিনি ডানপন্থী মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন, সেটা সম্ভবত ক্রিশ্চিয়ান চরম পন্থা।’
সে দেশের বার্তা সংস্থা এটিবি জানায়, ব্রেইভিক একটি বৈধ অস্ত্রের মালিক। তাঁর একটি সবজির খামার আছে। এ খামারের জন্য তিনি বিপুল পরিমাণ সার রাখতে পারেন। ধারণা করা হচ্ছে, বোমা ঘটনার সঙ্গে তিনি জড়িত এবং বোমার উপাদান হিসেবে তিনি সার ব্যবহার করেছেন। একজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, ছোটখাটো কিছু অপরাধ ছাড়া ওই বন্দুকধারীর বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি অপরাধের তথ্য নেই।
নরওয়ের গণমাধ্যম জানায়, ব্রেইভিকের একটি টুইটার অ্যাকাউন্ট আছে। তিনি সেখানে একটিমাত্র বার্তা পোস্ট করেছেন, তাও মাত্র কয়েক দিন আগে। ওই টুইটে তিনি লেখেন, ‘কোনো একটি মতাদর্শে বিশ্বাসী মানুষের শক্তি এক লাখ মানুষের সমান।’
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য: গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী জেনস স্টলটেনবার্গ বলেন, ‘একটি স্বর্গীয় দ্বীপ নরকে পরিণত হয়েছে।’ এ হামলার কারণ সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে চাননি তিনি। তবে তিনি বলেন, ‘আমি বলব, অন্য দেশের মতো আমাদের দেশে চরম পন্থা কোনো বড় সমস্যা নয়, তবে কিছু সংগঠন আছে। তাদের বিষয়টি আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে এবং আমাদের পুলিশও বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন আছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমাদের দেশে এ ধরনের ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা কখনো ঘটেনি। এটা আমাদের কাছে দুঃস্বপ্নের মতো।’
বিশ্বজুড়ে নিন্দা: অসলোতে বিস্ফোরণ এবং উটোয়া দ্বীপের বন্দুকধারীর গুলির ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ন্যাটো এবং রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, চীন, জাপান, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশ।
শেখ হাসিনার নিন্দা: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে এক বার্তায় বলেন, ‘সন্ত্রাসীদের কোনো সীমান্ত নেই। এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা।’ নরওয়ের জনগণের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে তিনি নিহত ব্যক্তিদের আত্মার শান্তি কামনা করেন।প্রথম আলো
অসলোতে বোমা: অসলোতে বিস্ফোরণ ঘটে স্থানীয় সময় বেলা তিনটার দিকে। শহরের মধ্যাঞ্চলে প্রচণ্ড শব্দে ওই বিস্ফোরণ ঘটে। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর, অর্থ মন্ত্রণালয়, তেল মন্ত্রণালয় ও দেশের প্রধান ট্যাবলয়েড পত্রিকা ভিজের প্রধান কার্যালয় ওই এলাকায় অবস্থিত। বিস্ফোরণের সময় প্রধানমন্ত্রী জেনস স্টলটেনবার্গ নিজের কার্যালয়ে ছিলেন না।
স্টেট সেক্রেটারি ক্রিস্টিন অ্যামুন্ডসেন বলেন, শুক্রবার ছিল সরকারি ছুটির দিন। কাজেই অন্য দিনের মতো ভবনগুলোতে সরকারি কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন না। তার পরও ওই ভবনগুলোতে প্রতিদিন শত শত মানুষ থাকে।
বিস্ফোরণে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের ১৭ তলা ভবনসহ পাশের বহুতল সরকারি ভবনগুলোর জানালার কাচসহ কাঠামো ভেঙেচুরে রাস্তায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে। কোনো কোনো ভবনের নিচের তলাও বিধ্বস্ত হয়। বিস্ফোরণে ভিজের প্রধান কার্যালয়ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
পুলিশ জানায়, এটি গাড়িবোমা হামলা ছিল বলে তাদের মনে হয়েছে, তবে তারা নিশ্চিত নয়। গতকাল পর্যন্ত কোনো পক্ষ ওই বিস্ফোরণের দায় স্বীকার করেনি।
ন্যাটোর সদস্য দেশ নরওয়েতে এর আগে কখনো এ ধরনের হামলার ঘটনা ঘটেনি। তবে আফগান যুদ্ধে জড়িত হওয়ার পর থেকে কখনো কখনো আল-কায়েদার হুমকির মুখে পড়েছে দেশটি।
বন্দুকধারীর গুলি: রাজধানী থেকে মাত্র ১৭ মাইল দক্ষিণের ছোট্ট দ্বীপ উটোয়া। পাইন বনে ঢাকা দ্বীপটি লম্বায় মাত্র আধা কিলোমিটারের মতো। শুক্রবার দেশের ক্ষমতাসীন দল লেবার পার্টির যুব সংগঠনের গ্রীষ্মকালীন সম্মেলন হচ্ছিল সেখানে। সারা দেশ থেকে সেখানে জড়ো হয়েছিলেন সংগঠনের এক হাজারের মতো নেতা-কর্মী ও সমর্থক। তাঁদের বেশির ভাগই তরুণ। প্রধানমন্ত্রী জেনস স্টলটেনবার্গের গতকাল শনিবার ওই সম্মেলনে যোগ দেওয়ার কথা ছিল।
শুক্রবার বিকেলে অসলোতে বিস্ফোরণের ঘণ্টা দুয়েক পর উটোয়ায় হামলা চালায় একজন বন্দুকধারী। পুলিশবেশী ওই হামলাকারী নির্বিচারে গুলি চালাতে শুরু করে।
গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, বন্দুকধারীর কাছে একটি হাতবন্দুক, একটি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ও একটি শটগান ছিল।
এনআরকে টেলিভিশনের একজন সাংবাদিক বলেন, পুলিশের পোশাক পরা ওই বন্দুকধারী ফেরিতে করে মূল ভূখণ্ড থেকে দ্বীপটিতে পৌঁছায়। সে জানায়, অসলোতে বিস্ফোরণের কারণে সে তল্লাশি করতে সেখানে এসেছে। এরপর সে লোকজনকে এক জায়গায় জড়ো হতে বলে। লোকজন জড়ো হওয়ার পরই সে গুলি চালাতে শুরু করে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বন্দুকধারী ওই লোক বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে থাকে। সম্মেলনে অংশ নেওয়া অনেকে তখন প্রাণভয়ে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি শুরু করেন। অনেকে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
উটোয়া থেকে মাত্র কয়েক শ মিটার দূরে অবস্থিত টেরিফোর্ড এলাকা। সেখানকার বাসিন্দা এনিটা লেইন বলেন, ‘দেখলাম, মানুষ দল বেঁধে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। ৫০ জনের মতো সাঁতরে তীরে ওঠে। এরপর সবাই কান্নায় ভেঙে পড়ে। সবার চোখে-মুখে রাজ্যের আতঙ্ক। এদের বেশির ভাগের বয়স ১৪ থেকে ১৯ বছরের মধ্যে।’
বন্দুকধারীর ওই নারকীয় তাণ্ডব থেকে বেঁচে গেছেন জর্গান বেনোনি। তিনি বলেন, ‘দেখলাম, টা...টা...টা...শব্দে একটার পর একটা ঝড়ের মতো গুলি হচ্ছে। পাখির মতো পড়ে যাচ্ছে মানুষ। আমিও সঙ্গে সঙ্গে বসে পড়লাম। নিজেকে লুকানোর চেষ্টা করলাম কয়েকটি পাথরের আড়ালে। সেখান থেকেই একনজর দেখলাম হামলাকারীকে, মাত্র ২০-৩০ মিটার দূরে।’
বেনোনি আরও বলেন, ‘একটু দূরে তীরে দেখলাম, কয়েকটি নৌকা ভেড়ানো আছে; কিন্তু আমি সাহস পেলাম না ওই নৌকায় উঠতে। পরে ঝাঁপিয়ে পড়লাম পানিতে।’
হানা নামের ১৬ বছরের এক কিশোর যোগ দিয়েছিল ওই সম্মেলনে। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সে বলে, ‘একটু আগে অসলোর বিস্ফোরণের খবরটি আমরা জানতে পারি। এক পাশে দাঁড়িয়ে কয়েকজন মিলে তা নিয়ে কথা বলছিলাম। দেখলাম, একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে এক পুলিশ। হঠাৎ করে ওই পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি করতে শুরু করল। যে যেভাবে পারল দৌড় দিল সৈকতের দিকে। পানিতে পড়ে সাঁতরাতে শুরু করলাম।’
এভাবে চলতে থাকে গুলির বৃষ্টি আর প্রাণভয়ে মানুষের ছোটাছুটি। কেউ ঝাঁপিয়ে পড়ে পানিতে, কেউ নিজেকে লুকানোর চেষ্টা করে ঝোপ-জঙ্গলের মধ্যে। অবশেষে জীবিত অবস্থায় আটক করা হয় বন্দুকধারীকে।
থেমে যায় তাণ্ডব। ততক্ষণে রক্তে লাল হয়ে গেছে ছোট্ট সুন্দর সবুজ দ্বীপটি। গতকাল দুপুর পর্যন্ত ৮৫ জনের মৃত্যু নিশ্চিত করে পুলিশ।
কে এই হামলাকারী: দীর্ঘ হত্যাযজ্ঞের পর ঘটনাস্থল থেকেই বন্দুকধারীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। নাম অ্যান্ডারস বেহরিং ব্রেইভিক। বয়স ৩২ বছর। বেশ লম্বা গড়নের এই যুবক নরওয়েরই নাগরিক। ডানপন্থী সংগঠনের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল বলে জানিয়েছে পুলিশ। তা ছাড়া তিনি ইন্টারনেটেও ডানপন্থী ও মুসলিমবিরোধী মত প্রকাশ করেছিলেন।
একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, বন্দুকধারীকে ঘটনাস্থলেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরে তাঁকে অসলোতে পুলিশ স্টেশনে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘এটা অদ্ভুত ব্যাপার যে বন্দুকধারী আত্মহত্যা করেনি। এ ধরনের ঘটনায় হামলাকারী সাধারণত আত্মহত্যা করে থাকে।’
অপর একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের কাছে তাঁর সম্পর্কে বেশি কিছু তথ্য নেই। তাঁর নিজের ওয়েবসাইট ঘেঁটে মনে হচ্ছে, তিনি ডানপন্থী মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন, সেটা সম্ভবত ক্রিশ্চিয়ান চরম পন্থা।’
সে দেশের বার্তা সংস্থা এটিবি জানায়, ব্রেইভিক একটি বৈধ অস্ত্রের মালিক। তাঁর একটি সবজির খামার আছে। এ খামারের জন্য তিনি বিপুল পরিমাণ সার রাখতে পারেন। ধারণা করা হচ্ছে, বোমা ঘটনার সঙ্গে তিনি জড়িত এবং বোমার উপাদান হিসেবে তিনি সার ব্যবহার করেছেন। একজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, ছোটখাটো কিছু অপরাধ ছাড়া ওই বন্দুকধারীর বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি অপরাধের তথ্য নেই।
নরওয়ের গণমাধ্যম জানায়, ব্রেইভিকের একটি টুইটার অ্যাকাউন্ট আছে। তিনি সেখানে একটিমাত্র বার্তা পোস্ট করেছেন, তাও মাত্র কয়েক দিন আগে। ওই টুইটে তিনি লেখেন, ‘কোনো একটি মতাদর্শে বিশ্বাসী মানুষের শক্তি এক লাখ মানুষের সমান।’
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য: গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী জেনস স্টলটেনবার্গ বলেন, ‘একটি স্বর্গীয় দ্বীপ নরকে পরিণত হয়েছে।’ এ হামলার কারণ সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে চাননি তিনি। তবে তিনি বলেন, ‘আমি বলব, অন্য দেশের মতো আমাদের দেশে চরম পন্থা কোনো বড় সমস্যা নয়, তবে কিছু সংগঠন আছে। তাদের বিষয়টি আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে এবং আমাদের পুলিশও বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন আছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমাদের দেশে এ ধরনের ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা কখনো ঘটেনি। এটা আমাদের কাছে দুঃস্বপ্নের মতো।’
বিশ্বজুড়ে নিন্দা: অসলোতে বিস্ফোরণ এবং উটোয়া দ্বীপের বন্দুকধারীর গুলির ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ন্যাটো এবং রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, চীন, জাপান, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশ।
শেখ হাসিনার নিন্দা: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে এক বার্তায় বলেন, ‘সন্ত্রাসীদের কোনো সীমান্ত নেই। এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা।’ নরওয়ের জনগণের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে তিনি নিহত ব্যক্তিদের আত্মার শান্তি কামনা করেন।প্রথম আলো
0 comments:
Post a Comment