Total Pageviews

Feedjit Live

Friday, July 29, 2011

বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্র কাদেরকে নির্যাতনতিন পুলিশ কর্মকর্তা সাময়িক বরখাস্ত, তদন্তের নির্দেশ হাইকোর্টের

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবদুল কাদেরকে হাইকোর্ট থেকে হাসপাতালে নেওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবদুল কাদেরকে হাইকোর্ট থেকে হাসপাতালে নেওয়া হয়
ছবি: প্রথম আলো
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবদুল কাদেরের ওপর নির্যাতনের ঘটনা তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার নিচে নন, এমন ব্যক্তি দিয়ে কমিটি গঠন করে তদন্ত করতে আইনসচিবকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
তদন্তকালে খিলগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হেলাল উদ্দিন, উপপরিদর্শক (এসআই) আলম বাদশা ও সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) শহিদুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করতে পুলিশের মহাপরিদর্শককে (আইজিপি) নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পৌনে সাতটার দিকে বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এ নির্দেশ দেন।
এর আগে আদালতের নির্দেশ অনুসারে বিকেল পাঁচটার দিকে অ্যাম্বুলেন্সে করে আবদুল কাদেরকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে হাইকোর্টে আনা হয়। সোয়া পাঁচটা থেকে ছয়টা ৫০ মিনিট পর্যন্ত আদালত নির্যাতনের শিকার আবদুল কাদের, অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মামুন রশীদ চৌধুরী, আইনজীবী আবদুল মতিন খসরু ও খিলগাঁও থানার ওসি হেলাল উদ্দিনের বক্তব্য শোনেন।
এ সময় হুইলচেয়ারে বসা প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র কাদের তাঁর ওপর নির্মম নির্যাতনের বর্ণনা দেন। তখন তিনি দাঁড়াতেও পারছিলেন না। আদালতের নির্দেশে পরনের টি-শার্ট খুললে পিঠে আঘাতের চিহ্ন দেখা যায়।
কাদের আদালতকে বলেন, পুলিশ তাঁকে চাপাতি দিয়ে আঘাত করেছে। ওসি অবশ্য এ অভিযোগ অস্বীকার করেন। প্রায় দুই ঘণ্টার শুনানি শেষে আদালত আদেশ দেন।
আদালত তাৎক্ষণিকভাবে আবদুল কাদেরকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (বিএসএমএমইউ) পাঠাতে স্বরাষ্ট্রসচিব, আইজিপি, ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার ও আইজি প্রিজনকে নির্দেশ দেন। কাদেরের মা-বাবা তাঁকে যেকোনো সময় দেখতে যাওয়ার সুযোগ পাবেন। আইজিপিকে বিভাগীয় তদন্ত করারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আট সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে। কাদেরের পক্ষে সংশ্লিষ্ট আদালতে ন্যায়বিচার চেয়ে আবেদন করার পরামর্শও দেওয়া হয়েছে।
ঘটনাপ্রবাহ: ১৫ জুলাই গভীর রাতে আবদুল কাদেরকে খিলগাঁও থানার পুলিশ আটক করে। পরদিন তাঁকে ডাকাতির প্রস্তুতি ও অস্ত্র আইনের মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়। গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ডেইলি স্টার-এর এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন নজরে এলে আদালত বেলা সাড়ে তিনটার মধ্যে কাদেরকে হাইকোর্টে হাজির করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন। একই সময় খিলগাঁও ও মোহাম্মদপুর থানার ওসিকে হাজির হতে বলা হয়। এ ছাড়া কাদেরকে নির্যাতন থেকে কেন অব্যাহতি দেওয়া হবে না এবং দোষীদের বিরুদ্ধে কেন আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করা হয়।
তখন পৌনে তিনটা: আদালতের নির্ধারিত সময়ের আগে পৌনে তিনটায় এজলাসে হাজির হন দুই ওসি। তাঁরা আদালতকে জানান, লিখিত আদেশ না পাওয়ায় কাদেরকে কারাগার থেকে আনা যাচ্ছে না। আদালত বলেন, তাঁকে আজই (বৃহস্পতিবার) আনতে হবে। আদালত লিখিত আদেশের অনুলিপি তাৎক্ষণিক সরবরাহ করতে বলেন। কাদের না আসা পর্যন্ত দুই ওসিকে থাকতে বলেন। তখন অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় থেকে আইজি প্রিজনের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়।
অবশেষে বিকেল পাঁচটার দিকে কারাগার থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে কাদেরকে আনা হয় হাইকোর্টে। হুইলচেয়ারে করে তাঁকে এজলাসকক্ষে নেওয়া হয়। এর আগে সোয়া তিনটার দিকে আদালতে আসেন কাদেরের মা মনোয়ারা বেগম ও বোন জান্নাতুল মাওয়া। এরপর আসেন অধ্যাপক মামুন রশীদ চৌধুরী ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান। আদালত তাঁদেরও আসতে অনুরোধ করেছিলেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হুইলচেয়ারে করে এজলাসকক্ষে প্রবেশের আগে কাদেরের মা ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। কাদেরও কাঁদছিলেন।
এজলাসকক্ষে: কাদের আদালতকক্ষে ঢোকার পর তাঁর শিক্ষক মামুন রশীদ চৌধুরী বলেন, কাদের মাস্টার্সে পড়ছে। সে নিরীহ ছেলে। সে কোনো ধরনের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নয়। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও জড়িত নয়। সে ক্লাসের সবচেয়ে ভদ্রদের একজন। সে ডাকাতির সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে না। কাদেরকে মুক্ত করার আরজি জানিয়ে মামুন রশীদ বলেন, ‘বহু কাদের এভাবে হারিয়ে যাচ্ছে। আমাদের কাদের যেন হারিয়ে না যায়। পুলিশের প্রতি শ্রদ্ধার অভাব নেই। তবে প্রশ্ন, নিরীহ ছেলেটাকে নিয়ে গিয়ে কেন এমন করা হলো?’
এরপর আদালত কাদেরের বক্তব্য শুনতে চান। আদালত জানতে চান কোত্থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জবাবে কাদের বলেন, শুক্রবার রাত দেড়টার দিকে সেগুনবাগিচার দুদক কার্যালয়ের সামনে থেকে সাদা পোশাকের পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে।
তারা যে পুলিশ কীভাবে বুঝলেন—আদালতের এ প্রশ্নের জবাবে কাদের বলেন, ‘যারা আমাকে আঘাত করেছে, তারাই আমাকে থানায় নিয়ে যায়। এতে বুঝতে পারি, তারা পুলিশ। আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পরিচয় দেই, তখন তারা বলে, যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তারাই বেশি ডাকাতি করে। এ কথা বলে আরও বেশি নির্যাতন করে। আমার পিঠে ও হাতে আঘাত করা হয়। একপর্যায়ে আমি প্রায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।’ এ কথা বলার সময় কাদের কান্নায় ভেঙে পড়েন। তখন এজলাসকক্ষে উপস্থিত কাদেরের মা ও বোনও কাঁদছিলেন।
কাদের বলেন, ‘থানায় নিয়ে যাওয়ার পরও আমার ওপর নির্যাতন করা হয়েছে। খিলগাঁও থানার ওসি নিজে নির্যাতন করেছেন।’
সাড়ে পাঁচটার দিকে আদালত তাঁর পরনের জামা খুলে দেখাতে বলেন। জামা খোলার পর অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান বলেন, সারা পিঠে পেটানোর দাগ দেখা যাচ্ছে। এ সময় অধ্যাপক মামুন রশীদ বলেন, ‘আমাদের কাদেরকে ছেড়ে দিন।’
এ পর্যায়ে আদালত ওসি হেলাল উদ্দিনের বক্তব্য শুনতে চাইলে তিনি বলেন, গাড়িতে করে ডাকাতির প্রস্তুতিকালে কাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়। সাদা পোশাকের পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। তার কাছ থেকে চাপাতিসহ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। আদালত জানতে চান, ওই সময় কারা দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। জবাবে হেলাল উদ্দিন বলেন, এসআই আলম বাদশার নেতৃত্বে একটি দল। কখন ও কোত্থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে? জবাবে ওসি বলেন, রাত সাড়ে তিনটার দিকে খিলগাঁও ফাঁড়ির সামনে থেকে। কারা আঘাত করেছে? ওসি হেলালের জবাব, গণপিটুনিতেই কাদের আহত হয়েছেন। জনতাই তাঁর ওপর আঘাত করেছে।
আদালত জানতে চান, তাহলে যারা নির্যাতন করেছে, তাদের গ্রেপ্তার করলেন না কেন? সে যদি ডাকাত হয়েও থাকে, আপনি তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেন না কেন? জবাবে ওসি বলেন, ‘আমরা তাঁকে ফার্স্ব এইড (প্রাথমিক চিকিৎসা) দিয়েছি।’
আদালত বারবার ওসিকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ‘আপনি মিথ্যা কথা বলবেন না। মিথ্যা কথা বললে ইউনিফর্ম খুলে আমরা সরাসরি আপনাকে নাজিমউদ্দিন রোডে পাঠিয়ে দেব।’
এ পর্যায়ে আদালত ওসিকে এফআইআর পড়তে বলেন। ওসি এফআইআর পড়ে শোনান। আদালত বলেন, কটা মামলা হয়েছে। ওসির জবাব, দুটি। অন্যটি কী? ওসির জবাব, অস্ত্র মামলা।
আদালত ওসির কাছে জানতে চান, ‘আপনি নাকি চাপাতি দিয়ে মেরেছেন, কাদের বলেছে। ওসি অস্বীকার করে বলেন, এটা ঠিক নয়। এ পর্যায়ে আদালত কাদেরের কাছে জানতে চান, মাথায় আঘাত পেয়েছে কি না। কাদের বলেন, ‘মাথায় মারার চেষ্টা করে। কিন্তু আমি হাত দিয়ে ঠেকাই।’
এ সময় আইনজীবী আবদুল মতিন খসরু বলেন, কাদেরের বাবা শিক্ষা কর্মকর্তা। কাদের মেধাবী ছেলে। নির্যাতনে তার হাতের আঙুল ফেটে গেছে। এ অবস্থার সমাপ্তি হওয়া উচিত।
এ পর্যায়ে শুনানিতে অংশ নিয়ে অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, কাদেরকে পুলিশ নির্দয়ভাবে পিটিয়েছে। এ ধরনের ঘটনা অনেক ঘটছে। এটা চলতে দেওয়া যায় না। ইদানীং পুলিশ কিছু হলেই বলছে, এটা গণপিটুনি। এ ধরনের কথা বলে তারা গণপিটুনিকে বৈধতা দিচ্ছে। এটা খুবই ভয়ংকর। এভাবে গণধোলাইয়ের অধিকার দিলে সাধারণ মানুষের অধিকার কোথায় গিয়ে ঠেকবে! এতে বোঝা যায়, দেশে আইনশৃঙ্খলা কী অবস্থায় রয়েছে। এটা মানবাধিকার লঙ্ঘনের বড় উদাহরণ।
শুনানিকালে মিজানুর রহমান হেফাজতে নিয়ে পুলিশি নির্যাতনের জন্য রাষ্ট্রকে দায়ী করলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এর প্রতিবাদ জানান। অধ্যাপক মিজান বলেন, পুলিশ সংস্কারের জন্য কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হচ্ছে। এই কী সংস্কারের নমুনা!
আদালত বলেন, পুলিশ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। সাধারণ নাগরিক অপরাধ করলে যে সাজা পাবে, পুলিশকেও সে সাজা পেতে হবে।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘সাংবাদিকেরা অনুসন্ধান করে এ ঘটনাটি জাতির সামনে প্রকাশ করেছেন। এ জন্যই আমরা বিষয়টি জানতে পেরেছি। পুলিশ রাষ্ট্রের অপরিহার্য অংশ। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় পুুলিশই রাজারবাগে প্রথম আঘাতের শিকার হয়।’ তিনি বলেন, সব ঘটনা না জেনে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা ঠিক হবে না। কাউকে শাস্তি দেওয়াও উচিত হবে না।
আদালত বলেন, ‘আমরা এখন কাউকে শাস্তি দিচ্ছি না। তবে তদন্ত চলাকালে তাঁদের সাসপেন্ড করতে হবে। না হলে তদন্ত প্রভাবিত হতে পারে।’
হাসপাতালে কাদের: কাদেরের বোন জান্নাতুল মাওয়া প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল রাত সাড়ে ১০টার দিকে কাদেরকে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিজন সেলে ভর্তি করা হয়। আদালতের নির্দেশনা ছিল বাবা-মা প্রয়োজন মতো ছেলের দেখাশোনা করতে পারবেন। তবে প্রিজন সেল থেকে ভেতরে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত মাকে এক মিনিটের জন্য ঢুকতে দেওয়া হয়। মা কাদেরকে রাতের খাবার দিয়ে আসেন।

0 comments:

Post a Comment

Twitter Delicious Facebook Digg Stumbleupon Favorites More