ব্যাপারটি নিয়ে ভাবছি বেশ কিছুদিন হলো। সমাধান খুঁজে পাচ্ছিনা। কারো সাথে শেয়ারও করতে পারছিনা। পাছে না আবার ভাবে, পাগল! আদার খুচরো দোকানদার, জাহাজ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে! পরে ভাবলাম যা আছে কপালে। জাতির সাথেই শেয়ার করি। দু’পাঁচ জনের কাছে পাগল সেজে লাভ নেই। পাগল বললে পুরো জাতি পাগল বলুক। জাতীয় পাগল হতে পারাও মন্দ হবে না।
আমি যেহেতু ছোট লেখক, তাই লেখাটি ছোট করেই লিখে পাঠিয়েছিলাম দৈনিক সমকালে। গণতন্ত্র ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা শিরোণামে। দৈনিক সমকাল ১৮ জুন'১১ইং সংখ্যায় যা প্রকাশিত হয়েছিলো
একটি কথা আছে,
কাজির গাই, কেতাবে আছে গোয়ালে নাই!
ভাবছি, গণতন্ত্রের বেলায় এটি সমভাবে প্রযোজ্য হয়ে যায় কিনা!!
বর্তমান বিশ্বে সবচে’ সমাদৃত ও গ্রহণযোগ্য রাষ্ট্রনীতি হচ্ছে গণতন্ত্র। আমাদের দেশেও। যদিও এদেশে গণতন্ত্রের পোশাক পরে রাজতন্ত্রের অশরীরি আত্মাগুলোকেই ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়, তবুও।
যদিও আমাদের গণতন্ত্রের থলের ভেতরেই ঘাপটি মেরে বসে থাকতে দেখা যায় উর্দি শাসনকে স্বাগত জানানোর পাইক-পেয়াদাদের, তুবও।
আমরা ভাবতে ভালোবাসি, বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ। যদিও এদেশের রাস্তা-ঘাটে, গ্রাম-শহরে, অফিস-আদালতে, এমনকি জাতীয় সংসদেও, অবলা গণতন্ত্রকে ধর্ষিত হতে দেখা যায়। গণতন্ত্রের কোমল বুকে ছুরি বসিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে মসনদ হাসিল করার ঘটনাও ঘটে। তবুও।
আমরা সেই গণতন্ত্রকে বিশ্বাস করি। যে গণতন্ত্রের বুকে পা রেখে উপরে উঠা যায়। সেই গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি আমরা, যে গণতন্ত্র আমাদের পৌঁছে দিতে পারে ক্ষমতার শীর্ষ বিন্দুতে। আমরা গণতন্ত্রের প্রতি ততক্ষণ আস্থাশীল থাকতে পারি, যতক্ষণ আমার স্বৈরতান্ত্রিক আচরণে বাধা হয়ে না দাড়ায় ।
গণতন্ত্র মানে হচ্ছে, জনগণের জন্য জনগণের মনোনিত জনগণের সরকার। অর্থাৎ রাষ্ট্রের জনগণ যাকে চাইবে, যাদেরকে চাইবে, তারাই করবে সরকার গঠন। তারাই চালাবে রাষ্ট্র। কিন্তু কথা হচ্ছে দেশের সকল মানুষের চাওয়া তো আর সমান হয়না। কেউ চায় অমুককে তো কেউ চায় তমুককে। কেউ ভোট দেয় আম গাছকে তো কেউ আবার তাল গাছকে। এ জন্য ব্যাপারটির নিষ্পত্তি করা হয়েছে এভাবে,
কোনো আসনের অধিকাংশ মানুষ যাকে ভোট দেবে, তিনিই হবেন নির্বাচিত। এ ধারাই অনুসৃত হয়ে আসছে বিশ্বব্যাপী। স্থানীয় নির্বাচন থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত। কোনো নির্বাচনী এলাকায় অধিকাংশ মানুষ যাকে সমর্থন জানাচ্ছে, তিনিই পাচ্ছেন নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে জনগণের খেদমত (!) করবার সুযোগ। আর আমার প্রশ্ন এখানেই। আমার খটকার জায়গাটিই এটি। আমার বোঝার ভুলও হতে পারে। কেউ হয়তো ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করবেন। সমস্যাটির ব্যাখ্যা আছে আমার কাছে। সমাধান নিয়ে ভাবা হয়নি। কেউ হয়তো ভাববেন। কিংবা কে জানে অন্য কোনো সূত্রে বিষয়টি মীমাংসিতই আছে কিনা। জানার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করবো আমি। আর এই সাথে জানিয়ে রাখি, গণতন্ত্রের ফজিলত বর্ণনা করা বা পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করার জন্য এই লেখা নয়। বিষয়টি হচ্ছে গণতন্ত্রের কেতাবী সংজ্ঞা এবং প্রায়োগিক বাস্তবতার মাঝে মিল-অমিল সংক্রান্ত।
বুঝতে পারছিনা কীভাবে প্রকাশ করবো। গণতান্ত্রিক শাসন কাঠামোর মূল কথা হচ্ছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের পছন্দ ও সমর্থনের ভিত্তিতেই জন-প্রতিনিধি বা সরকার গঠিত হবে। কিন্তু একটু সুক্ষ্মভাবে ক্যালকুলেশনে গেলে দেখা যায় এর ব্যতিক্রম হয়েও সরকার গঠিত হতে পারে। আর হচ্ছেও। তাও আবার গণতান্ত্রিকভাবেই।
দেখা গেলো, অধিকাংশ মানুষ কাউকে বা কোনো দলকে পছন্দ করলো না, সমর্থন জানালো না, তারা চাইলোনা এরা নির্বাচিত হোক বা সরকার গঠন করুক। কিন্তু গণতন্ত্রের দেয়ালের ঠিক মধ্যেখানে থাকা বেশ বড় একটি ছিদ্র দিয়ে তাদেরও সুযোগ হয়ে উঠছে নির্বাচিত হবার বা সরকার গঠনের। আর এমনটি অহরহই হচ্ছে। উদাহরণ দিচ্ছি।
মনে করা যাক, কোনো আসনের মোট ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ। নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন ৫ জন। ভোট কাস্ট হলো ৮০%। ধরে নেয়া যাক হিসাবটা দাঁড়ালো এভাবে,
যিনি নির্বাচিত হলেন, তিনি পেলেন ৯০ হাজার ভোট।
২য় অবস্থানে থাকা প্রার্থী পেলেন ৮০ হাজার।
৩য় জন ৪০ হাজার।
বাকী দু’জন পেলেন ৩০ হাজার ভোট।
এলাকার ২০% বা ৬০ হাজার লোক ভোট দেয়নি অর্থাৎ কাউকেই সমর্থন জানায়নি।
এবারে অবস্থা দাঁড়ালো এই যে,
মিস্টার এক্স ৯০ হাজার ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়ে গেলেন। এর মানে তার এলাকার ৯০ হাজার মানুষ সমর্থন জানালো তাকে। তারা চাইলো মিস্টার এক্স এমপি হোন। কিন্তু পরাজিত ৪ প্রার্থী মিলে পেয়েছিলেন ৮০ হাজার যোগ ৪০ হাজার যোগ ৩০ হাজার সমান ১ লক্ষ ৫০ হাজার ভোট। এর মানে এই দেড় লক্ষ মানুষ মিস্টার এক্সকে চাইল না। তারা চেয়েছে তার বিকল্প। আর তাদের এই চাওয়াটা খন্ড খন্ড হয়ে যাওয়াতে সুযোগটা পেয়ে যান মিস্টার এক্স। ফলাফল দাঁড়ালো, ৯০ হাজার মানুষের পছন্দ এবং দেড় লক্ষ মানুষের অপছন্দকে পুঁজি করে গণতন্ত্রের ছিদ্র দিয়ে তিনিই হয়ে গেলেন নির্বাচিত!
গণতন্ত্রের মূল কথাটি আবারো সামনে নিয়ে আসা যাক। জন প্রতিনিধি নির্বাচিত হবেন অধিকাংশের সমর্থনের ভিত্তিতে। অথচ এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। অধিকাংশ মানুষ যাকে চায়নি, তিনিই হয়ে যাচ্ছেন নির্বাচিত। ব্যাপারটি কেমন হয়ে গেলো না?
পূর্বোল্লিখিত সম্ভাবনা এবং অনেকটা বাস্তবতাকে আমলে নিয়ে যে ছকটি দাঁড়ায়, তা হচ্ছে, দেখা গেলো কোনো দল প্রদত্ত ভোটের ৪৫% ভোট পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সরকার গঠন করে ফেললো। সেটা হলো একটা গণতান্ত্রিক সরকার।
অথচ সরকারকে ভোট দেয়নি- এমন মানুষের সংখ্যা ৫৫%। তাহলে কেমন করে বলা যায় গণতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্থায় দেশের অধিকাংশ মানুষের মতামতের ভিত্তিতেই সরকার গঠিত হয়ে থাকে?
ব্যাপারটির কোনো সহজ সমাধান আপাতত সামনে নেই আমার। চিন্তাজীবি যারা, তাদের কাছে থাকলেও থাকতে পারে।
অতি সম্প্রতি হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদ নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে একটি ফর্মুলা প্রস্তাব করেছেন। বলেছেন, নির্বাচন হবে দলীয় ভিত্তিতে। অর্থাৎ, মানুষ বিশেষ কোনো প্রার্থীকে ভোট দেবেনা। ভোট দেবে নৌকা, ধানের শীষ, লাঙ্গল ইত্যাদি মার্কাকে অর্থাৎ দলকে। যে দল সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষের সমর্থন পাবে, তারাই করবে সরকার গঠন। প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে স্ব স্ব দল প্রার্থী মনোনিত করে তাদের জীবনের আমলনামাসহ নির্বাচন কমিশনে পাঠাবে। নির্বাচন কমিশন মনোনিত ব্যক্তিকে সার্বিক বিবেচনায় যোগ্য মনে করলে তবেই তাকে ঘোষণা করা হবে নির্বাচিত হিসেবে।
এরশাদ সাহেবের এই ফর্মূলার পক্ষে বিপক্ষে দু'দিকেই যুক্তি আছে। ফর্মূলাটি গ্রহণ করে নেয়া হলে কালোটাকার মালিকরা টাকার বিনিময়ে ভোট কিনে এমপি হবার সুযোগ পাবেন না। পেশি শক্তির কিংবদন্তিরা জোর করে কেন্দ্রদখল করে এবং গায়ের জোরে জিতে আসার সুযোগ পাবেন না। গণতন্ত্রের সংজ্ঞা অনুযায়ী দেশের অধিকাংশ মানুষ যাদের চাইবে তারাই করবে সরকার গঠন। কারণ সামনে থাকবে প্রাপ্ত ভোটের সর্বমোটের আনুপাতিক পরিসংখ্যান।
আবার এর দুর্বল দিকও আছে। এতে কার দলের প্রধান ও প্রভাবশালী অংশের সেচ্ছাচারিতা ও দৌরাত্ব লাগামহীন হয়ে যেতে পারে। তাদের ভাই-বেরাদার, ভাগ্নে-মামা তথা আত্মীয়-স্বজনদের ভারে বিষাক্ত হয়ে উঠতে পারে সংসদ। যেহেতু মাঠ পর্যায়ে পয়সা খরচ করতে হচ্ছেনা, সে জন্যে কোঠি টাকার নমিনেশন বাণিজ্যের স্থলে মনোনয়ন বাণিজ্যের টাকার অংক চলে যেতে পারে শত কোটিতে। সেই সঙ্গে সংসদ ভরে যেতে পারে অযোগ্যদের দ্বারা।
গণতন্ত্রের যে দুর্বল দিকটির কথা আমি উল্লেখ করলাম, জানি না সেটা আসলেই দুর্বলতা কিনা! হয়ে থাকলে এর সমাধান কী? প্রথম আলো ব্লগ
0 comments:
Post a Comment