সরকারবিরোধী জোরালো আন্দোলন গড়ে তুলতে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী জোটের বাইরে বেশ কিছু ধর্মভিত্তিক দল ও সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। এরা একমঞ্চে না এসে দল দুটির দাবির সঙ্গে একাত্ম হয়ে কর্মসূচি পালন করবে।
এই অলিখিত সমঝোতার অংশ হিসেবে ধর্মভিত্তিক ১১টি সংগঠন কাল রোববার ও সোমবার টানা ৩০ ঘণ্টা হরতাল কর্মসূচি দিয়েছে। গতকাল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী এই হরতাল কর্মসূচিতে সমর্থন দিয়েছে। চারদলীয় জোট ও ধর্মভিত্তিক দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলাম গতকাল পৃথক সংবাদ সম্মেলনে হরতালের প্রতি সমর্থনের কথা জানান।
জানা গেছে, ধর্মভিত্তিক দলগুলোর ডাকা হরতাল কর্মসূচির পেছনে বিএনপি-জামায়াতের হাত আছে। জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সমমনা দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক রেখে আন্দোলন কর্মসূচি পালন করার বিষয়ে আমরা স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা করেছি। তারা আমাদের কর্মসূচিতে সমর্থন দিয়েছে, আমরাও তাদের কর্মসূচিতে সমর্থন জানিয়েছি। কারণ, আমাদের দাবি ও তাদের দাবির বিষয়গুলো একই।’
একই বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, ‘সবার সঙ্গে ওভাবে যোগাযোগ নেই। তবে কিছু ব্যক্তি ও দলের সঙ্গে যোগাযোগ আছে।’
এদিকে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর ধর্মীয়সংক্রান্ত কিছু ধারার বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন দল ইসলামী আন্দোলন রোববার সারা দেশে হরতাল ডেকেছে। দলটি ৩ জুলাইও ঢাকায় আধা বেলা হরতাল পালন করে।
একই দাবিতে ধর্মভিত্তিক ১১টি রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের মোর্চা (বর্তমানে ২০ সংগঠন) রোববার দিনরাত ও সোমবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৩০ ঘণ্টার হরতাল ডাকে। সংগঠনগুলোর একাধিক নেতা বলেছেন, তাঁরা লাগাতার কর্মসূচির কথাও ভাবছেন।
বিএনপি এবং ওই দলগুলোর দাবি একই: বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী যেসব দাবিতে ৬ ও ৭ জুলাই ৪৮ ঘণ্টার হরতাল করেছে, ধর্মভিত্তিক দলগুলোও একই দাবিতে হরতাল ডেকেছে।
৩০ জুন জাতীয় সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী বিল পাস হওয়ার পর থেকে ধর্মভিত্তিক দলগুলো বিক্ষোভ-সমাবেশ করে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে আসছে।
সংবিধানের মূলনীতি থেকে ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ কথাটি তুলে দিয়ে সেখানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ও ‘সমাজতন্ত্র’ প্রতিস্থাপন করার প্রতিবাদ জানিয়ে তারা এ কর্মসূচি দেয়।
এ ছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ডের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের ধারা সংযোজন ও সংবিধানের ২৫(২) ধারা এবং মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক সংহত, সংরক্ষণ ও জোরদার করার ধারা বাতিল করার বিষয়েও দলগুলোর আপত্তি আছে। এর সঙ্গে জাতীয় নারীনীতি, শিক্ষানীতি বাতিলের দাবিও যুক্ত করেছে তারা।
এ ছাড়া সংশোধনীতে বহাল রাখা সংবিধানের প্রস্তাবনার ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম’-এর অনুবাদকে ‘বিকৃত অনুবাদ’ বলে দাবি করেছে জামায়াতে ইসলামীসহ ধর্মভিত্তিক দলগুলো। বন্ধনীতে ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম’-এর বাংলা অর্থ ‘দয়াময়, পরম দয়ালু, আল্লাহর নামে’ লেখার পর বাড়তি একটি বাক্য ‘পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার নামে’ যুক্ত করা হয়েছে।
নেপথ্যে বিএনপি: সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এ বছরের শুরুতে চারদলীয় জোটের শরিক ধর্মভিত্তিক একটি দলের প্রধানকে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামতে বলেন।
ওই সূত্রের দাবি, ফতোয়া, নারীনীতি, শিক্ষানীতিসহ একাধিক ধর্মীয় বিষয়ে আলেম সমাজ আন্দোলনে না নামায় খালেদা জিয়া উষ্মা প্রকাশ করেন। তাঁর সময়ে কথায় কথায় আলেমরা মাঠে নামতেন বলেও খোঁচা দেন। খালেদা জিয়া ওই নেতাকে হরতালসহ কঠোর কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামতে তাগাদা দেন।
সূত্র জানায়, বিএনপির শীর্ষ পর্যায় থেকে উৎসাহ জোগানো হচ্ছিল, যাতে ধর্মভিত্তিক দলগুলো বর্তমান সরকারের ধর্মীয় বিষয়ে বিতর্কিত সিদ্ধান্তগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামে। বিএনপির চেয়ারপারসনের সঙ্গে একাধিক বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন, এমন একটি ধর্মভিত্তিক দলের নেতা বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
গত মার্চে বিষয়টি নিয়ে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেন সম্মিলিত ওলামা মাশায়েখ পরিষদের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মাওলানা মুহিউদ্দিন রব্বানি। তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার সঙ্গে ওলামা পরিষদের প্রথম বৈঠকে তিনি শিক্ষানীতি, নারীনীতি, ফতোয়া, ধর্মভিত্তিক রাজনীতিসহ ধর্মীয় বিষয়ে বিএনপির অবস্থান প্রকাশ করতে বলেন। তখন পর্যন্ত বিএনপি এসব বিষয়ে দলের অবস্থান প্রকাশ করেনি।
মুহিউদ্দিন রব্বানি জানান, তাঁর এ বক্তব্যে খালেদা জিয়া অপ্রস্তুত হন। ‘আপনারা কী করছেন?’ বলে খালেদা জিয়া বৈঠকে উপস্থিত আলেমদের সামনে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান।
আন্দোলন জমানোর মতো নানা বিষয় হাতে পেয়েও বিএনপি সরকারবিরোধী কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে দাঁড়াতে পারছে না। শরিক জামায়াতে ইসলামীও যুদ্ধাপরাধের বিচারসহ নানা কারণে কোণঠাসা।
বিএনপির সঙ্গে সংগঠনগুলোর সম্পর্ক: হরতাল আহ্বানকারী ১১ সংগঠনের অনেক নেতা বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সম্পর্ক রাখেন বলে জানা গেছে। তবে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এই জোট থেকে সরে গিয়ে স্বতন্ত্র অবস্থান বজায় রাখার চেষ্টা করছে। ১১ সংগঠনের একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ইসলামী আন্দোলন সব সময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে সখ্য বজায় রেখে চলে।
১১টি দল হচ্ছে: বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, সম্মিলিত ওলামা মাশায়েখ পরিষদ, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি, ইসলামী ঐক্য আন্দোলন, নেজামে ইসলাম পার্টি, ইসলামিক পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাপ, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ ও ন্যাপ-ভাসানী।
এগুলোর মধ্যে জাগপা, এনডিপি, নেজামে ইসলাম পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাপসহ অন্তত সাতটি দল বিএনপির জোটে ভিড়তে আগ্রহী। এসব দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির চেয়ারপারসনের সঙ্গে তাঁর গুলশানের কার্যালয়ে একাধিকবার বৈঠক করেন।
বিষয়টি স্বীকার করে বাংলাদেশ ন্যাপের মহাসচিব গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বিএনপির নেতৃত্বে বর্তমান সরকারের দেশ ও ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নিতে চাই।’
এ ছাড়া সম্মিলিত ওলামা মাশায়েখ পরিষদের সঙ্গে জামায়াতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। সংগঠনটির নির্বাহী কমিটির সদস্য যাইনুল আবেদীন জামায়াতের কর্মপরিষদের সদস্য। তিনি জামায়াতের নিয়ন্ত্রণাধীন তামীরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ। যুগ্ম মহাসচিব খলিলুর রহমান মাদানিসহ এ সংগঠনের নীতিনির্ধারকদের আরও কয়েকজন জামায়াতের সদস্য অথবা সাংগঠনিক পদে আছেন। গত শুক্রবারও সংগঠনটির বিক্ষোভ কর্মসূচিতে জামায়াত-শিবিরের কর্মী ও সমর্থকেরা অংশ নেন।
এই জোটের আরেকটি ধর্মভিত্তিক দলের মহাসচিবের সঙ্গে ৪ জুলাই রাতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের একান্ত বৈঠক হয় বলে জানা গেছে। দলটি এত দিন বিএনপির সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে চলছিল।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস চারদলীয় জোটের শরিক ছিল। একসময় তারা জোট থেকে বেরিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটে যুক্ত হয়েছিল। আওয়ামী লীগের সঙ্গে তারা বিতর্কিত পাঁচ দফা চুক্তিও করে। অবশ্য এই বন্ধন বেশি দিন টেকেনি। এখন তারা কোনো জোটে নেই।
জিজ্ঞেস করলে খেলাফত মজলিসের নায়েবে আমির আবদুর রব ইউসুফী কোনো দলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার কথা অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের কর্মসূচির সঙ্গে জাগতিক কোনো সম্পর্ক নেই। ইমানের দাবিতে আমরা হরতাল দিয়েছি।’
নতুন নয় দল: ১১ দলের জোট থেকে ইসলামী আন্দোলন সরে যাওয়ার পর আরও নয়টি নামসর্বস্ব সংগঠনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সংগঠনগুলো হচ্ছে: আইম্মা পরিষদ, ইসলাহুল মুসলিমীন, বাংলাদেশ জাতীয় ফতোয়া বোর্ড, নাস্তিক মুরতাদ প্রতিরোধ জাতীয় কমিটি, সচেতন যুবসমাজ, আহকামে শরিয়াহ হেফাজত কমিটি, বাংলাদেশ জাতীয় ওলামা পরিষদ, জাতীয় তাফসির পরিষদ ও জমিয়তুল মুফাসসিরিন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বাংলাদেশ জাতীয় ওলামা পরিষদের সভাপতি দ্বীন মোহাম্মদ কাসেমী বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত আছেন। তিনি জাতীয়তাবাদী ওলামা দলের ঢাকা মহানগর কমিটির সভাপতি। তবে দ্বীন মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এখন আর ওলামা দলের সঙ্গে নেই। তবে আলেমদের নিয়ে একটি বৃহত্তর ঐক্য গড়ার লক্ষ্যে কাজ করছি।’
আহকামে শরিয়াহ হেফাজত কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক আবু ইউসুফ খান তামীরুল মিল্লাত মাদ্রাসার উপাধ্যক্ষ। এই সংগঠনের সদস্য-সচিব আবদুস সবুর মাতুব্বর ঢাকা মহানগর জামায়াতের একটি থানা কমিটির আমির ছিলেন।
২০টি দল ও সংগঠনের মূল শক্তি হচ্ছে সম্মিলিত ওলামা মাশায়েখ পরিষদ। এর ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মাওলানা মুহিউদ্দিন রব্বানি। তাঁর নেতৃত্বাধীন সংগঠন আইম্মা পরিষদও জোটে যুক্ত হয়েছে। মুহিউদ্দিন রব্বানি সংগঠনটির সভাপতি।
0 comments:
Post a Comment