Total Pageviews

Feedjit Live

Saturday, July 2, 2011

দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়বে


সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী নিয়ে বিশিষ্ট নাগরিকদের অভিমত

হারুন আল রশীদ 
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হওয়ায় দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়বে। আরও তীব্র হবে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিরাজমান আস্থাহীনতা ও অবিশ্বাস। বিষয়টি আগামী সংসদ নির্বাচনকেও হুমকির মুখে ঠেলে দেবে। এই অভিমত দেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের।
প্রথম আলোর পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে সংবিধান বিশেষজ্ঞ, আইনজ্ঞ, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা এই অভিমত দেন। তাঁরা মনে করেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা থাকার সময়ও একধরনের বিতর্ক ছিল। তাই সব দল মিলে বিতর্ক এড়াতে একটি বিকল্প গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা খুঁজে বের করলে ভালো হতো।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করে গত ৩০ জুন সংসদে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বিল পাস হয়েছে। এতে সংবিধানের প্রস্তাবনা ও মৌলিক বিষয়গুলো সংশোধনের অযোগ্য করা হয়েছে।
বিশিষ্ট আইনবিদ রফিক-উল হক বলেন, সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী অবৈধ; তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাও অসাংবিধানিক; এ বিষয়ে আমার কোনো দ্বিমত নেই। এই ব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্কও রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশের যে রাজনৈতিক বাস্তবতা, তাতে বিকল্প কোনো ব্যবস্থা না রেখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে ফেলে দেওয়া ঠিক হয়নি। তা ছাড়া আদালতও বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা দুই মেয়াদে রাখা যেতে পারে। এখন বিএনপি যদি আগামী নির্বাচন বর্জন করে, তখন কী ঘটবে! সে জন্যই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে হলেও দুই পক্ষের সমানসংখ্যক সদস্য নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিকল্প হিসেবে একটি ব্যবস্থা রাখা যেত। রফিক-উল হক বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বাইরে অন্য যেসব সংশোধনী এসেছে, সেগুলো ভালোই বলা যায়।
বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সভাপতি ড. কামাল হোসেন এ বিষয়ে গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার মাধ্যমে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের নিশ্চয়তা ছিল। এই বিধানটি বাতিল করে দিয়ে সরকার দেশের নির্বাচনব্যবস্থাকে হুমকির মুখে ঠেলে দিল। আগামীতে রাজনৈতিক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে সেই নির্বাচনে বিরোধী দল অংশ নেবে কি না, আর নিলেও সেই নির্বাচন কতটা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
কামাল হোসেন আরও বলেন, ১৯৯৪ সালের মাগুরা উপনির্বাচন এবং ’৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির একতরফা নির্বাচনের অগ্রহণযোগ্যতা থেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা আসে। তখন নির্বাচন কমিশন থেকে জানানো হয়েছিল, দেশের প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনী তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। যে কারণে তারা সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারছিল না। তাই দেশের চলমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন ছিল। গণতন্ত্রকে আরও সুসংহত করে এই ব্যবস্থা বাতিলের চিন্তাভাবনা করা যেত।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সভাপতি অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ বলেন, এই সংশোধনীর মাধ্যমে সরকার সংবিধানকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। কারণ সংবিধান সাধারণ কোনো আইন নয় যে ইচ্ছেমতো সংশোধন করে দেওয়া যায়। কিন্তু বর্তমান সরকার তা-ই করল। যে মামলার রায়ে ত্রয়োদশ সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক বলা হয়েছে, সেই মামলার চূড়ান্ত রায় এখনো প্রকাশিত হয়নি। সেই পর্যন্ত অপেক্ষা না করেই সরকার সংবিধান সংশোধন করে ফেলল। এটা দুঃখজনক। এ ধরনের একটি সংশোধনীর আগে রাজনৈতিক মতৈক্যের প্রয়োজন ছিল।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে বিশেষ কমিটি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ আমলে নেয়নি বলেও মন্তব্য করেন অধ্যাপক মোজাফ্ফর। তিনি বলেন, বিশেষজ্ঞদের বেশির ভাগই তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। কমিটিও তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রাখার পক্ষে ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর কমিটির সিদ্ধান্ত পাল্টে গেল। এতে প্রমাণিত হয়, কমিটি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেনি। এটি কমিটি ব্যবস্থার জন্য খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে গেল।
সংবিধানের প্রস্তাবনা ও মৌলিক অধ্যায় অসংশোধনযোগ্য করা সম্পর্কে মোজাফ্ফর আহমদ বলেন, সংবিধানের কতিপয় অনুচ্ছেদ সংশোধনের জন্য গণভোটের যে বিধান ছিল, সেটি রাখা হয়নি। মৌলিক কিছু পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু সময়ের পট-পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মৌলিক বিষয়েও পরিবর্তন আনা বাঞ্ছনীয়। সে দৃষ্টিকোণ থেকে অসংশোধনযোগ্য ধারা যুক্ত করাটা অযৌক্তিক।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খান বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিলোপের মাধ্যমে সরকার আগামী নির্বাচনকে তীব্র সংকটের মুখে ফেলে দিল। আগামী নির্বাচনে বিএনপি যদি অংশ না নেয়, সেই দায় সরকারকে বহন করতে হবে। তবু আশার কথা, এখনো দুই বছর সময় আছে। সংকট এড়াতে হলে সরকারকে যেকোনো মূল্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে গ্রহণযোগ্য সমাধানে যেতে হবে। প্রয়োজনে বিকল্প কোনো পদ্ধতিও নেওয়া যেতে পারে।
আকবর আলি খান মনে করেন, সংবিধানের অন্যান্য জায়গায় যেসব সংশোধনী এসেছে, সেখানে সরকারের বোধের চেয়ে আবেগ বেশি কাজ করেছে। এসব সংশোধনীর রাজনৈতিক তাৎপর্য থাকলেও আইনগত কোনো তাৎপর্য নেই। এ নিয়ে বড় দুই দলের মধ্যে তীব্র বিরোধ সৃষ্টি হওয়ার মতো কোনো মতপার্থক্যও নেই। মূল বিরোধের জায়গা হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সুতরাং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য বিরোধী দলকে নির্বাচনে আনতেই হবে। সে জন্য বিকল্প হিসেবে অন্য কোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রবর্তন করতে হবে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে রাজনৈতিক দলগুলোই বিতর্কিত করেছে। যখন যে দল পরাজিত হয়েছে, তারাই বলেছে, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। তার পরও দেশের জনগণ মনে করে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থাপনায় নির্বাচন সুষ্ঠু হয়। যে কারণে বলা যায়, এ পদ্ধতি বাতিল হওয়ায় আগামীতে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের সুযোগ নষ্ট হবে। কারণ রাজনৈতিক সরকারের অধীনে নির্বাচন করার মতো অবস্থা আমাদের দেশে এখনো তৈরি হয়নি।’
সুলতানা কামাল মনে করেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আরও দুই মেয়াদের জন্য রাখা হলে তত দিনে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আরও সুসংহত হতো। এ জন্য বিএনপিও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়নি। আবার তাদের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়েই সরকার একক ক্ষমতাবলে যা করেছে, সেটাও সুখকর নয়। তবু হতাশ হওয়ার কিছু নেই। এখনো দুই-আড়াই বছর সময় আছে। মতৈক্যের ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিকল্প হিসেবে দুই পক্ষে সমান সদস্য নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা যেতে পারে। আশা করি, এ বিষয়ে দলগুলোর শুভবুদ্ধির উদয় হবে।’
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে দেওয়ায় প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে যে আস্থাহীনতা ও অবিশ্বাস রয়েছে, তা আরও গাঢ় হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে আগামী নির্বাচনকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দেওয়া হলো।
হোসেন জিল্লুর আরও বলেন, সংবিধান সংশোধনে জনপ্রতিনিধিরা অংশ নিলেও আক্ষরিক অর্থে এতে জনমতের প্রতিফলন ঘটেনি। এমনকি কমিটি যে সংলাপ করেছে, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তারও প্রতিফলন দেখা যায়নি। বিশেষজ্ঞ সুপারিশের সিংহভাগই গ্রহণ করা হয়নি। বরং সংশোধিত সংবিধানের মাধ্যমে শাসনব্যবস্থায় জবাবদিহিতা নষ্ট হয়েছে এবং সরকারের একচ্ছত্র আধিপত্য তৈরির পথ সুগম হয়েছে।

0 comments:

Post a Comment

Twitter Delicious Facebook Digg Stumbleupon Favorites More