Total Pageviews

Feedjit Live

This is default featured post 1 title

Go to Blogger edit html and find these sentences.Now replace these sentences with your own descriptions.This theme is Bloggerized by Lasantha Bandara - Premiumbloggertemplates.com.

This is default featured post 2 title

Go to Blogger edit html and find these sentences.Now replace these sentences with your own descriptions.This theme is Bloggerized by Lasantha Bandara - Premiumbloggertemplates.com.

This is default featured post 3 title

Go to Blogger edit html and find these sentences.Now replace these sentences with your own descriptions.This theme is Bloggerized by Lasantha Bandara - Premiumbloggertemplates.com.

This is default featured post 4 title

Go to Blogger edit html and find these sentences.Now replace these sentences with your own descriptions.This theme is Bloggerized by Lasantha Bandara - Premiumbloggertemplates.com.

This is default featured post 5 title

Go to Blogger edit html and find these sentences.Now replace these sentences with your own descriptions.This theme is Bloggerized by Lasantha Bandara - Premiumbloggertemplates.com.

Friday, August 26, 2011

পাকিস্তানীদের দৃষ্টিতে বাঙালি, বাঙালি মুসলিম, সামরিক বাহিনী, ১৯৭১ এর স্বাধীনতা সংগ্রামের কারণ, ঘটনা এবং উপলদ্ধি- একটি বিশ্লেষণ

ডিসেম্বরের দানবেরা-
পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের পথ
১৯৭১ এ পৌঁছার ঘটনাক্রম নিয়ে কলামিস্ট হামিদ হোসেনের একটি চমৎকার বিশ্লেষণ

(দুর্বল অনুবাদের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী)
ভূমিকা-
Great blunders are often made, like large ropes, of a multitude of fibres.
Victor Hugo’s Les Miserable


বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং পাকিস্তানের ভাঙন উদযাপনের মাস হল ডিসেম্বর। যারা কোনো না কোনো ভাবে আক্রান্ত হয়েছেন ইতিহাসের সেই সন্ধিক্ষণের স্মৃতি দুটি দেশের সবার জন্যই খুব মর্মান্তিক । খুব কম ক্ষেত্রেই বিভিন্ন দিক নিয়ে নিরাবেগভাবে এবং পুংখানুপুংখ বিশ্লেষণ হয়েছে সেই সময়ের । বেশিরভাগ লেখালেখিই সীমাবদ্ধ থেকেছে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ আর কাদা ছোঁড়াছুড়ির মধ্যে। সরকারী বা একাডেমিক তদন্তের অভাবে বেশিরভাগ তথ্য-প্রমাণই মেঘাচ্ছন্ন থেকেছে শুধুই আবেগী মতামতের আড়ালে। কেউ কেউ একজনকে বেছে নিয়ে গোটা তাণ্ডবের জন্য দোষারোপ করেছেন। বাকিরা প্রিয়জনদের বাঁচিয়ে অন্য কারো ঘাড়ে পিণ্ডি চাপিয়েছেন। সেই সন্ধিক্ষণে অনেকেরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে এবং প্রত্যেকেই ফলাফলের ভাগ পেয়েছেন। ইতিহাসের পুরো অংশটুকু উপেক্ষা করে বেশিরভাগ আলোচনাই সীমাবদ্ধ থেকেছে নাটকের শেষ দৃশ্যে যা ১৯৭১ সালে অভিনীত হয়েছিল। সংকটের শেষ অংশে যখন ইতিহাসের গতিস্রোত তার পূর্ণ বেগে তখন একজন মন্তব্যকারী তাই সঠিকভাবেই দেখিয়েছিলেন যে শুধুমাত্র একজন কখনোই ইতিহাসের স্রোতের দিক পরিবর্তন করতে পারেন না। যেকোনো সাধারণ পাত্র-পাত্রীর চেয়েও তা অনেক বেশি শক্তিশালী।[১]

পাকিস্তানের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির পরস্পরের মধ্যে বাস্তব বিষয়ভিত্তিক সংঘর্ষ ছাড়াও রয়েছে হিংসা-বিদ্বেষ, গভীর প্রোথিত ভুল ধারণা, কুসংস্কার এবং গৎবাঁধা চিন্তা-ভাবনা। পারস্পরিক অবিশ্বাসের এই আবহাওয়া এবং সংঘর্ষ নিরসনের উদাহরণের অভাবে বিভিন্ন দলের মধ্যে প্রকাশ্যসংঘর্ষ ব্যতিক্রমের বদলে হয়ে ওঠে সাধারণ নিয়ম। পাকিস্তানের শাসকশ্রেণী বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির রাজনৈতিক চেতনাকে দেখে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড হিসেবে। এই নাশকতাবাদী শক্তিকে পরাস্ত করার জন্য তারা ইসলাম ও দেশ এই দুই যমজ হাতিয়ারকে ব্যবহার করেছে।[২]

যখন শাসকশ্রেণী গঠিত প্রভাবশালী একটি জাতিগোষ্ঠি দিয়ে তখন রাষ্ট্রযন্ত্রের উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া একটি কাল্পনিক একতার দৃঢ় প্রত্যয় অন্যান্য জাতিগোষ্ঠির মাঝে প্রত্যাশিত সাড়ারই সৃষ্টি করে। তারা এটিকে প্রভাবশালী জাতিগোষ্ঠির চাপানো মূল্যায়ন এবং নিজেদের জাতিগত পরিচয়ের বিলুপ্তি হিসেবে ধরে নেয়।[৩]

এটি একটি দুষ্টচক্রের সৃষ্টি করে যেখানে পরিধির নিয়ন্ত্রণের প্রতিটি প্রচেষ্টাই গ্রাহক প্রান্তে থাকা ব্যক্তিটির মনোভাবকে শক্ত করে তোলে। রাষ্ট্রের অখণ্ডতার প্রতি হুমকি স্থানীয় প্রতিক্রিয়াকে প্রথম পদক্ষেপেই ধাবিত করে কেন্দ্রের চাপানো শক্তিশালী অবিভাজ্যতার দিকে এবং পরবর্তী সহিংস দমননীতি চলে ভিন্নমতের বিরুদ্ধে।[৪]

ফিরে দ্যাখা ইতিহাস-
আপনি কমপক্ষে বাঙালি নন,- ১৯৬২ সালে অনুষ্ঠিত সর্ব পাকিস্তান মৌলিক গণতন্ত্র সম্মেলনে কার্ল ভন ভরিসের সাথে তিনজন পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিনিধি আলাদাভাবে আলোচনার শুরু করেছিলেন এভাবে।[৬]

বাঙালি মুসলিমদের নিয়ে এই পক্ষপাতদুষ্ট কুসংস্কারের রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস এবং পাকিস্তানের অভ্যুদয়ের অনেক আগেই তা ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। উত্তর ভারতের মুসলিম বুদ্ধিজীবি, অভিজাতশ্রেণী এবং রাজনীতিবিদদের কাছে মুসলিম বলতেই লম্বা, সুদর্শন এবং যুদ্ধপ্রিয় চরিত্রের একজনের ছবি ভেসে উঠত। এই বৈশিষ্টগুলো শুধুমাত্র উত্তর ভারতের মুসলিমদের জন্যই প্রযোজ্য ছিল। যেহেতু বাঙালি মুসলিমেরা এই পক্ষপাতদুষ্ট কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও বর্ণবাদী ছবির সাথে মিলতোনা কাজেই তাদের যথাসম্ভব এড়িয়ে যাওয়া হতো। এমনকি যখন তাদের কাছে আসতে দেয়া হতো তখনো তাদের গণ্য করা হতো নিকৃষ্ট হিসেবে। রাজনৈতিক অগ্রগতি এবং দমন-পীড়ন ও জুলুমের বিরুদ্ধে তীব্র বিদ্বেষ থাকা সত্ত্বেও বাঙালিদের বাদ দেয়া হতো।বাঙালি মুসলিমদের একটি বড় অংশ ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন নিচু হিন্দু বর্ণ থেকে। ‘আশরাফ’ সম্প্রদায়েরা বিদেশী পুর্বপুরুষের দাবী করতেন[সৈয়দ, আফগান, মুঘল]। বাঙালি মুসলিম জনসংখ্যার বেশিরভাগের সাথেই হিন্দু কৃষকশ্রেণীর বিভিন্ন প্রথার মিল ছিলো এবং তাদের ভাষা নিয়ে একটি গর্বিত চেতনা ছিলো। কিছু বাঙালি ‘আশরাফ’ সম্প্রদায়ের লোক এবং পশ্চিম পাকিস্তানের প্রায় সবাই এদের ‘সত্যিকারের মুসলিম’ হিসেবে গণ্য করতেন না। ‘ইসলামিকিকরণ’ এবং পূর্ব বাঙালিদের সংস্কৃতির বিশুদ্ধকরণের অফিসিয়াল সিদ্ধান্তকে এই দৃষ্টিভঙ্গি পরে প্রভাবিত করে ১৯৪৭ এর পর।[৭]

‘যুদ্ধপ্রিয় জাতি’ সংক্রান্ত ইংরেজদের তত্ত্বকে নেটিভরা সাদরে বরণ করে এই প্রেক্ষাপটে। ইংরেজদের শ্রেণীবিভাগে বাঙালিদের ধরা হতো ‘নারীসুলভ’ জাতি হিসেবে। তাদেরকে ধরা হতো ‘দুর্বল ও মেরুদণ্ডহীন তবে ধুর্ত’ হিসেবে।[৮]

উনিশ শতকের শেষে এবং বিংশ শতাব্দীর শুরুতে কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম নেতা স্বতন্ত্র মুসলিম পরিচয়ের দ্বারা ভারত বিভাগের পক্ষে বক্তব্য রাখেন। বাঙালি মুসলিমদের নিয়ে পক্ষপাতদুষ্ট কুসংস্কার এতই প্রচলিত এবং বহুবিস্তৃত ছিলো যে কেউই তাদের নিয়ে চিন্তা করেননি এবং ভারতীয় মুসলিম সমাজের অংশ হিসেবে গণ্যও করেননি। পঞ্চাশ বছরে এরকম ১৫টি পরিকল্পনার প্রস্তাব করা হয়েছিলো যার একটিতেও বাংলা বা বাঙালি মুসলিমদের কথা উল্লেখ করা হয়নি।[৯]

১৯৩০ সালের বিখ্যাত এলাহাবাদ প্রস্তাবে স্যার মুহম্মদ ইকবাল বাঙালি মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত করেননি। নতুন দেশের জন্য পাকিস্তান নামটির আবিষ্কারক চৌধুরী রহমত আলী এর মধ্যে ভবিষৎত পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে খাপ খাওয়ানোর কোনো গরজই বোধ করেননি। সাধারণভাবে বলতে গেলে, উত্তর ভারতীয় মুসলিমরা নিজেদের উৎকৃষ্ট এবং অধিক বিশুদ্ধ রক্তের মনে করতেন এবং বাঙালি মুসলিমদের ঘৃণা করতেন। বাঙালি মুসলিমদের বিশ্বাসী ভাইয়ের চেয়ে হিন্দুদের তুলনীয় হিসেবেই তারা মনে করতেন। ১৯৪০ সালের পাকিস্তান প্রস্তাবের উপস্থাপক বাঙালি নেতা ফজলুল হককে বলপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছিল ১৯৪১ সালে। বাংলার নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দিকে মুসলিম লীগ নেতৃত্ব কখনোই বিশ্বাস করেনি। সর্ব ভারতীয় মুসলিম লীগের ওয়ার্কিং কমিটিতে তাঁকে একটি আসন পর্যন্ত দেয়া হয়নি। উঁচু শ্রেণীর অভিজাতেরা বাংলা মুসলিম লীগে কর্তৃত্ব ফলিয়েছেন। এটি রাজনৈতিক সমর্থন পেয়েছিল খাজা নাজিমুদ্দিন থেকে, অর্থনৈতিক সাহায্য পেয়েছিল মির্জা আবুল হাসান ইস্পাহানী থেকে এবং মিডিয়া সমর্থন পেয়েছিল মৌলানা আকরম খান থেকে।[১০]

১৯৪৭ সালে নতুন পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের সময় নতুন জাতিটি একটি খুবই অনন্য এবং কঠিন উভয়সংকটের মুখোমুখি হলো। দুটি অংশকে বিভক্ত করে রেখেছিলো ভারতের ১০০০ মাইলেরও বেশি বৈরী অঞ্চল। পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার অর্ধেক কিন্তু স্থলসীমা ছিল মোট স্থলসীমার ছয় ভাগের এক ভাগ।নৃতাত্ত্বিক ও ভাষাগতভাবে পূর্বাংশের জনগণ অধিক সমগোত্রীয় ছিলো যেখানে পশ্চিমাংশের পরিষ্কারভাবে পাঁচটি বিভিন্ন শ্রেণী ছিলো[পাঞ্জাবি, সিন্ধি, বালুচ, পশতুন এবং ভারত থেকে আসা নতুন অভিবাসী মুসলিম যারা মুহাজির হিসেবে পরিচিত।] পূর্বাংশে অমুসলিম জনসংখ্যা ছিলো ২৫% যেখানে পশ্চিমাংশে ছিলো মাত্র ৩%। পশ্চিম পাকিস্তানের বড় বড় সামন্ততান্ত্রিক ভূ-সম্পত্তির তুলনায় বাংলার কৃষিভূমির মালিকেরা কৃষি খাতে প্রভাবশালী ছিলো।[১১]


পাকিস্তানের বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে বাঙালিরা সবচেয়ে বেশি রাজনীতি সচেতন ছিলো। সেই সাথে বাংলায় বামপন্থীদের উপস্থিতির একটি সুদীর্ঘ ঐতিহ্য ছিলো। পূর্বে সাক্ষরতার হার ছিল ৩০% যেখানে পশ্চিম পাকিস্তানে ছিলো ২০%।[১২] ১৯৫০ সালে বাংলা প্রাদেশিক আইনপরিষদ East Bengal State Land Acquisition and Tenancy Act of 1950 নামে একটি যুগান্তকারী বিল পাশ করে। এই আইন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বিলুপ্ত করে যা অভিজাত ভূস্বামীদের পক্ষের জমিদারী প্রথার অবসান ঘটায়। জমি রাখার সীমা ১০০ বিঘা[প্রায় ৩৩ একর] এর মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয় যার ফলে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের জমিদাররাই ক্ষতিগ্রস্থ হয়।[১৩]

আমার চোখে এই প্রায় অজানা আইনটি ছিল একটি সঙ্কটপূর্ণ উপাদান যা পরবর্তিতে দুটি অংশের সম্পর্কের গতিপথে প্রভাব ফেলবে। এই আইন পশ্চিম পাকিস্তানী অভিজাত শাসকগোষ্ঠিকে সচকিত করে তোলে যাদের বেশিরভাগই ছিলেন ভূস্বামী ও জমিদারশ্রেণীর।

পাকিস্তানের দাবীর ছিলো একটি ‘সুদীর্ঘকালীন আবেদন যা কিছুদিনের জন্য মুসলিম সমাজগুলোর মাঝের গভীর বিভেদকে ঢেকে রেখেছিলো। যার জন্য পাকিস্তানের সৃষ্টি, অভ্যুদয়ের পর সেই স্পষ্টতার দাবী ছিলো সবার। এই ফুটে বের হওয়া প্রবণতাগুলো জেঁকে বসতে থাকে।[১৪]

এই হলো ১৯৪৭ এর স্বাধীনতা পর্যন্ত ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর পরিচ্ছেদ। দেশের পরবর্তী মহামারী সৃষ্টিকারী ঘটনাগুলো বোঝার জন্য এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

নতুন দেশের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক
তোমাদের গান কতো মধুর! আল্লাহর কাছে দোয়া করি, তোমরা যদি এর অর্ধেকও মধুর হতে!- বাঙালি বন্ধুকে ফিল্ডমার্শাল আইয়ুব খান।

স্বাধীনতার পরে দুটি অংশের বিভেদরেখা ধারাবাহিকভাবে বাড়াতে বেশকিছু উপাদান ভূমিকা রাখে। পশ্চিম পাকিস্তানী অভিজাতশ্রেণীর বাঙালিদের সহজভাবে সমান অংশীদার হিসেবে গ্রহণ করতে না পারাটা ছিলো এদের মধ্যে মূল উপাদান। আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে নয় বরং ঐতিহ্যগতভাবে বাঙালি অভিজাতশ্রেণীর ক্ষমতাগ্রহণের মাধ্যম ছিলো রাজনৈতিক প্রচারণা। বাঙালিদের দ্রুত বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার আংশিক কারণ ছিলো এটি। গনতান্ত্রিক সংস্কৃতির অনুপস্থিতি আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি সিদ্ধান্ত প্রদানকারী সভা বেসামরিক আমলাতন্ত্র এবং সেনাবাহিনীতে নগ্ন অনুপস্থিতি বাঙালিদের উপলদ্ধিকে শাণিত করে তোলে। ১৯৫৮ সালের গভীর কেন্দ্রনিয়ন্ত্রিত শাসনব্যবস্থা আর দলগুলোর প্রকাশ্য রাজনীতিতে নিষেধাজ্ঞা তাদেরকে কার্যকরভাবে জাতীয় দৃশ্যপট থেকে বাদ দিয়ে দ্যায়। সেই সাথে জাতীয় পর্যায়ে কিছু বলার মতও কাউকে রাখেনা।[১৫]

একটি ছোট্ট স্বার্থবাদী দলের বাস্তবতাকে উপলদ্ধির চরম মুর্খামি কিংবা বাঙালিদের নিয়ে গভীরে প্রোথিত বর্ণবাদীকুসংস্কার থেকে তৈরি দুর্বল চিন্তায় গঠিত সিদ্ধান্ত বাঙালিদের বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ায় অবদান রাখে । বিভিন্ন ফোরামে আলোচিত পরিপূর্ণ চিন্তাবিবর্জিত নীতিমালা জাতীয় একতার নামে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের নিয়ে কি করা হচ্ছে সে ব্যাপারে পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ জনগণকে সম্পূর্ণ অজ্ঞতায় রেখেছিলো। প্রাথমিক অসন্তোষের কারণটি ছিলো ভাষা নিয়ে যখন পাকিস্তান সরকার সিদ্ধান্ত নিলো শুধুমাত্র একটি জাতীয় ভাষা হবে এবং তা হবে উর্দু। এমনকি বাঙালি মুসলিম লীগ নেতারাও[তাজুদ্দিন আহমেদ এবং আবু হাশিম] বাঙালিদের অবহেলা এবং এর পরিণতি সম্পর্কে তাদের উপলদ্ধি প্রকাশ করেন। ১৯৪৭ এর সেপ্টেম্বরে পাকিস্তান সরকার শুধুমাত্র ইংরেজি এবং উর্দুতে কারেন্সি নোট, ধাতব মুদ্রা, মানি অর্ডার এবং পোস্টকার্ড প্রকাশ করে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান লোকপ্রশাসন উর্দু, ইংরেজি, হিন্দী, সংস্কৃত, ল্যাটিন এবং অন্যান্য ভাষায় আইনের ইশতেহার প্রকাশ করে কিন্তু বাংলাকে বাদ দেয়া হয়। হিন্দু প্রভাব থেকে বাঙালি সংস্কৃতিকে ‘বিশুদ্ধ’ করতে পাকিস্তান সরকার বাংলা লেখনী পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়। স্থানীয়দের মন-মানসিকতা এমনকি সংবিধানকেও সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে কেন্দ্রীয় সরকার আরবি লেখনীতে বাংলা শিক্ষা দেয়ার বিভিন্ন কেন্দ্র স্থাপন করে।[১৬]

বাঙালিদের প্রতিবাদ শুরু হয় এই ভাষা বিষয়টি নিয়ে। সর্বত্র ছড়িয়ে পড়া বাঙালিদের দাবিতে পাকিস্তান সরকার বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয় ১৯৫৪ সালে। কিন্তু এর ফলে দুটি অংশের বিভেদরেখা আরো প্রসারিত হয়ে যায়। বাঙালিদের প্রত্যেকটি ন্যায্য দাবিকে দোষারোপ করা হয় পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্র হিসেবে। শাসকগোষ্ঠি বাঙালিদের দাবির প্রবক্তাদের অভিহিত করে ‘দেশ বিরোধী’ এবং ‘ইসলাম বিরোধী’ হিসেবে। শাসকগোষ্ঠি এদের চরিত্র অনেকটা এভাবে দ্যাখায়, ‘পাকিস্তানের মাটিতে কুকুরেরা ছাড়া পেয়ে গেছে’। সোহরাওয়ার্দিকে নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়।[১৭]

পূর্ব পাকিস্তানের পাঞ্জাবি গভর্নর ফিরোজ খান নুন বাঙালিদের ভিন্ন মতের আওয়াজকে বর্ণনা করেন এভাবে, ” ধূর্ত রাজনীতিবিদগণ এবং ধ্বংসবাদীরা যারা রয়েছে মুসলিম সমাজে ও উঁচুবর্ণের হিন্দুদের মাঝে এবং কলকাতা ও পাকিস্তানের ভেতরের কম্যুনিস্টরা”।[১৮]

কেন্দ্রীয় সরকারের এই অসুস্থ নীতিমালা বাঙালিদের মনোভাবকে আরো শক্ত করে তোলে। ভবিষৎত সংবিধানসংক্রান্ত বিতর্ক দুটি অংশের প্রতিনিধিদের চিন্তাধারার বিভিন্নতাকে আরো প্রকাশিত করে। একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যকে উপেক্ষা করা হয়, তা হলো প্রথম সংবিধান পরিষদের সদস্যপদ। ৪৪ জন সদস্য ছিলেন পূর্ব বাংলার, ২২ জন পাঞ্জাবের, ৫ জন সিন্ধের, ৩ জন উত্তর-পশ্চিম ফ্রন্টিয়ার প্রদেশের এবং একজন বালুচিস্তানের। ১৯৪৯ সালে মৌলিক নীতিমালা সংক্রান্ত কমিটি তাদের রিপোর্ট জমা দ্যায় এবং নতুন জাতির জন্য জোটরাষ্ট্র ভিত্তিক গনতন্ত্রের প্রস্তাব করে। পাঞ্জাবের সদস্যেরা প্রতিবাদ করেন যে, শুধুমাত্র সংখ্যাধিক্যের জন্য বাঙালিদের আধিপত্য বিস্তারের অবস্থায় যেতে দেওয়া যাবেনা।[একইভাবে ১৯৭১ সালে জুলফিকার আলি ভুট্টো ক্ষমতার কেন্দ্র হিসেবে পাঞ্জাব এবং সিন্ধের পক্ষে অবস্থান নেন]। সংসদীয় গনতন্ত্র সম্পর্কে তাদের চিন্তা-ভাবনা সম্ভবত ভিন্ন ছিলো। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুমোদনের মানে হলো ‘নির্দিষ্ট কিছু নাগরিক অন্যদের চেয়ে বেশি তুলনীয়’।[১৯]

বাঙালিরা আইনপরিষদে এই দ্বৈতনীতি এই ভেবে গ্রহণ করে যে একইভাবে অন্যান্য ক্ষেত্রেও [অর্থনীতি, প্রশাসন এবং সেনাবাহিনী] বাঙালিদের অংশগ্রহণ সম্ভব হবে। পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষুদ্র প্রদেশগুলোর সাথে বাঙালিরা হাত মিলিয়ে তাদের দাবি আদায়ের জন্য চাপ দিতে পারে এই সম্ভাবনায় ভয় পেয়ে আইয়ুব খান [তিনি ছিলেন কমান্ডার ইন চীফ এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী] ‘একত্রীভূত পশ্চিম পাকিস্তানের’ ধারণা নিয়ে আসেন এবং চারটি প্রদেশকে একত্রিত করার প্রক্রিয়া শুরু করেন।[২০]

১৯৫৮ এর ক্যু এর পর আইয়ুব বজ্র মুষ্টিতে নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখেন এবং বেসামরিক আমলাতন্ত্রের দ্বারা সবকিছু পরিচালনা করতে থাকেন। পূর্ব পাকিস্তান থেকে আইয়ুবের নিজের হাতে বেছে নেওয়া ক্যাবিনেট সদস্যরা[মুহম্মদ ইবরাহীম, আবুল কাসেম খান এবং হাবিব উর রহমান] সংসদ বিষয়ক আলোচনায় বৃহত্তর স্বায়ত্বশ্বাসন দাবী করেন এবং গভীর কেন্দ্রশাসিত সরকারের ভয়ংকর পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করে দ্যান। এই আলোচনাগুলোতে বেশকিছু ৪:৩ ভোট প্রদান[৪ জন সদস্য ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের এবং ৩ জন পূর্বাংশের] পরিষ্কার ভাবে দুটি অংশের মন্ত্রীদের চিন্তাধারা এবং উদ্দেশ্যের মৌলিক পার্থক্য দেখিয়ে দ্যায়।[২১]

পূর্ব পাকিস্তানের মন্ত্রীদের যুক্তির জবাবে আইয়ুবের প্রতিক্রিয়া ছিলো এই যে, সংবিধান বাস্তবায়নের পর তিনি ক্যাবিনেট থেকে তিনজনকেই বহিষ্কার করেন।[২২]

এটি দেখিয়ে দ্যায় যে আইয়ুব ঐ তিনজন বাঙালি মন্ত্রীকে আলোচনার জন্য রেখেছিলেন বাঙালিদের মতামত বিবেচনা করা হচ্ছে দ্যাখানোর জন্য যেখানে আসলে তিনি তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে ক্ষুদ্ধ ছিলেন। প্রত্যাশিতভাবেই ১৯৬২ এর সংবিধান ঘোষণায় পূর্বাংশের ছাত্রদের নেতৃত্বে বিপুল বিক্ষোভ দ্যাখা যায়।

একইভাবে অর্থনৈতিক ইস্যুটিও ছিলো কণ্টকাকীর্ণ। কেন্দ্রীয় সরকার এটিকে একের পর এক অজুহাতে এড়িয়ে গেলেও এই ইস্যুতে বাঙালিদের সর্বসম্মত একতার কারণে আমলে নিতে বাধ্য হয়। ১৯৫১ সালে স্যার জেরেমি রিম্যানকে রাজস্ব খাতের বর্তমান বরাদ্দ এবং যেকোনো পরিবর্তনের সুপারিশে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তার সুপারিশকে পুরস্কার গ্রহণের মতই সাদরে বরণ করে নেওয়া হয়। বাঙালিরা এই পুরস্কারের ফলাফলকে গালগল্পে বিশ্বাসের মত করেই দ্যাখে। পূর্ব পাকিস্তানে রাজস্ব ঘাটতি ১৯৫২-১৯৫৩ সালে ৭ মিলিয়ন রুপিতে আসে ১৯৫১-১৯৫২ সালের ৪০ মিলিয়ন রুপি থেকে।[২৩]

আইয়ুব খানের এই গভীর কেন্দ্রশাসিত আইনব্যবস্থা বাঙালিদের আরো বিচ্ছিন্ন করে দ্যায় যেহেতু সেনাবাহিনী এবং আমলাতন্ত্রে তাদের উপস্থিতি ছিলো খুবই কম। এমনকি একজন অন্ধের কাছেও বাঙালিদের বিরাগ ছিলো পরিষ্কার তবুও শাসকরা তা উপেক্ষা করতে থাকে। বাঙালি জনতার মনোভাব সম্পর্কে জুলাই ১৯৬১ তে প্রকাশিত ইন্টিলিজেন্স ব্যুরোর[IB] রিপোর্টে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা হয় যে, “এই প্রদেশের জনতা ততক্ষণ পর্যন্ত সন্তুষ্ট হবেনা যদি না দেশের কার্যবিধির ব্যবস্থাপনায় তাদের সমান ও সার্থক অংশগ্রহণ সংবিধান নিশ্চিত না করে। উন্নতির জন্য সম্পদের সমান অংশ বণ্টন এবং বিশেষ করে বাঙালিদের প্রাদেশিক প্রশাসনের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ গ্রহণেও নিশ্চিত করতে হবে। বুদ্ধিজীবি সমাজ সংবিধানে বিস্তারিত নীতিমালা চান যাতে করে ডিফেন্স সার্ভিস এবং সেন্ট্রাল সার্ভিসে পূর্ব পাকিস্তানের অংশগ্রহণের বৃদ্ধি দ্রুততর হয়।”[২৪]

দুঃখের কথা এই যে, আই.বি. এর মাঝারি পদের একজন পুলিশ কর্মকর্তাও দেশের শাসকদের চেয়ে অধিক দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ছিলেন।

সরাসরি মুখোমুখি
‘আপনাদের কি এতে লজ্জা হয়না যে পূর্ব পাকিস্তানের প্রত্যেকটি ন্যায্য দাবির ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশকেও আপনাদের কাছ থেকে বিপুল মূল্যে এবং তিক্ত সংগ্রামের মাধ্যমে আদায় করতে হয় যেন এটি কোনো অনিচ্ছুক বিদেশী শাসকদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে অনিচ্ছুক আলোচনার মাধ্যমে??’- আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে।

১৯৭১ সহসা শূন্য থেকে ঘটেনি। কমপক্ষে কয়েক দশক ধরে চলে আসা ধারাবাহিকতার যৌক্তিক ফলাফল ছিলো এটি। মৌলিক ইস্যুগুলো চিহ্নিত করতে কোনো পদক্ষেপই নেওয়া হয়নি। বাঙালিদের প্রাথমিক প্রচেষ্টা ছিলো দেশের নীতি-নির্ধারণী প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়া। পরে এটি বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিবর্তিত হয় এবং এবং বৃহত্তর স্বায়ত্বশাসনের দিকে এগিয়ে যায়। অবশেষে পরিণত হয় পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামে। জাতীয় মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা প্রচারে নিষেধাজ্ঞা থেকে প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক পদক্ষেপ, এরকম প্রতিটি অসুস্থ চিন্তার পদক্ষেপই বাঙালি জনতাকে একধাপ করে এগিয়ে নিয়ে যায় বিচ্ছিন্নতার দিকে। এমনকি ৩০ বছর পরে সবকিছু ফিরে দ্যাখার পরও পাকিস্তান বাঙালি বিচ্ছিন্নতাবাদের মূল কারণ খুঁজে পেতে ব্যর্থ। ১৯৯৮ সালে একজন অবসরপ্রাপ্ত লে. জেনারেলের দৃষ্টিভঙ্গি এরকম,- “বাঙালি জাতীয়তাবাদ নিছকই আকস্মিক ছিলো। ভারত তার উদ্দেশ্য হাসিল এবং গোটা এলাকার উপর ব্যাপক চাহিদার কারণে একে লালন-পালন করেছে।”[২৫]

মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী [অব.][সেনা শাসনের সময় রাজনৈতিক উপদেষ্টা এবং সঙ্কট সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি জানা] সবকিছু ফিরে দ্যাখার পরেও ১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একতরফা বিজয়ে শুধু এই বলেন যে, ‘মোট ৩৭% ভোট গ্রহণ হয়েছিলো। এর মধ্যে ২০% ভোট দিয়েছিলো ভারতের হিন্দুরা, আওয়ামী লীগ পেয়েছিলো ১৫% আর জামাত এ ইসলামী পেয়েছিলো ২%।’[২৬] 

পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের দুর্বল সম্পর্কের কারণের ওপরে আরেকজন মন্তব্যকারীর দৃষ্টিভঙ্গি, ‘বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রে ভারতীয় লবির একগুয়ে মনোভাব’ এবং তার মতে এর কারণ হলো ‘দুই ভাইকে আলাদা রাখার স্বেচ্ছা প্রণোদিত নীতিমালা’।[২৭]

এসব মতামত থেকে এটা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে তাদের নিজের সমাজের মূল তথ্য-প্রমাণগুলো বোঝার ব্যাপারে সম্পূর্ণ অজ্ঞতা এবং তথ্যের ব্যাপক স্বল্পতা রয়েছে।

বাঙালিদের রাজনীতি কোনো নির্দিষ্ট ছাঁচে গড়ে ওঠেনি। মুসলিম লীগ নেতৃত্ব গড়ে উঠেছিলো অভিজাত ভূস্বামী এবং কলকাতার শহুরেদের নিয়ে। পরে গ্রামীণ জনগণের সমর্থনে দেশী নেতৃত্ব[ফজলুল হক এবং মাওলানা আবদুল হামিদ ভাসানী] দৃশ্যপটে আসে। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচন ছিলো পাকিস্তানের ইতিহাসের একটি সন্ধিক্ষণ। যুক্তফ্রন্ট[ফজলুল হকের কৃষক শ্রমিক পার্টি এবং সোহরাওয়ার্দির আওয়ামী লীগের সমন্বয়ে গঠিত] নির্বাচনে নিরংকুশ বিজয় অর্জন করে। ২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে ২২৩টিতেই যুক্তফ্রন্ট জেতে এবং অপর ৭২টি অমুসলিম আসনের বেশিরভাগের সাথেই তাদের মিত্রতা ছিলো। এই নির্বাচনে মুসলিম লীগ পূর্ব পাকিস্তান থেকে ধুয়েমুছে যায়। আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যয়ভারে কম্যুনিজমের বিরুদ্ধে সামরিক চুক্তি নতুন বাঙালি নেতৃত্বের ব্যাপারে পশ্চিম পাকিস্তানী অভিজাত শাসকশ্রেণীর উপলদ্ধি পুনরায় জোরদার করে। এখন আভ্যন্তরীণ, ব্যক্তিগত এবং শ্রেণীস্বার্থের একটি জটিল উপাদানগুচ্ছের উদ্ভব ঘটে। আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক মহলের ক্রীড়াচক্র নতুন জাতির জায়মান গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। ১৯৫৪ এর ফেব্রুয়ারীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষরের সময় পূর্ব বাংলায় সাধারণ প্রতিবাদ অনুষ্ঠিত হয়। বেশকিছু বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করা হয় এবং নবনির্বাচিত সাংসদেরা একটি প্রতিবাদলিপিতে স্বাক্ষর করেন। এই স্বাক্ষর প্রাদেশিক পরিষদের মৃত্যুর রায় হিসেবে প্রমাণিত হয়। করাচীর শাসকগোষ্ঠী[গভর্নর জেনারেল গোলাম মুহম্মদ, সি-ইন-সি আইয়ুব খান এবং প্রতিরক্ষা সচিব ইস্কান্দার মির্জা] তাদের দূরদৃষ্টিতে দেশের এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভবিষ্যৎ সম্পর্কের ওপর চরম হুমকি হিসেবে দেখলেন এই পরিস্থিতিকে। যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক হবে নীতিমালার ভিত্তিপ্রস্তর। ওয়াশিংটনকে পাকিস্তানের একনিষ্ঠ মিত্রতা এবং নিজ দেশের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ যে আছে তা দ্যাখানোর জন্য তারা সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন যে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক চিন্তাধারাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ওপর দিয়ে যেতে হবে। ১৯ মে ১৯৫৪ সালে করাচিতে পারস্পরিক প্রতিরক্ষা ঐক্য স্বাক্ষরিত হয়। ১১ দিন পরে গভর্নর জেনারেল পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদকে এই ঠুনকো অভিযোগে বাতিল করলেন যে, ফজলুল হক ভারতীয় মাধ্যমের কাছে বিচ্ছিন্নতাবাদী বক্তব্য রেখেছেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্বপ্রাপ্তের কাছে গোপনে বলেন যে কম্যুনিস্টদের খুঁজে একজোট করার জন্য পূর্ব পাকিস্তানে গভর্নর আইনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। তিনি নিশ্চিত করেন যে এ ব্যাপারে এমনকি ক্যাবিনেটে বা মুখ্যমন্ত্রীদের সাথেও আলোচনা করা হয়নি কারণ পিকিং বা মস্কোতে ফজলুল হক দ্বারা তথ্য ফাঁসের আশংকা আছে।[২৮]

বাঙালিদের সোজা করতে কেন্দ্রীয় সরকার তার সবচেয়ে কুখ্যাত দুই আমলাকে[ইস্কান্দার মির্জা এবং এন. এম. খান] গভর্নর হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠায়। পরিকল্পনাটি স্বল্প মেয়াদে তড়িঘড়ি করে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ছিলোনা বরং আইয়ুব খান মার্কিন রাষ্ট্রদুতকে গোপনে এর দীর্ঘমেয়াদ সম্পর্কে জানান। পাকিস্তানী নীতিনির্ধারকরা সবসময়ই দেশবাসীর চেয়ে বিদেশীদের বেশি আপনজন মনে করে। আইয়ুব খুবই দিলখোলাভাবে মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে জানান যে, “পূর্ব পাকিস্তানে দীর্ঘ সময়ের জন্য সামরিক আইন বজায় রাখতে হতে পারে।”[২৯]

আইয়ুবের ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৯ এর শাসনামলে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং শক্তিশালী কেন্দ্র শাসিত শাসনব্যবস্থা বাঙালিদের আরো পেছনের দিকে ঠেলে দ্যায়। জনতা বিক্ষোভে ফুঁসে উঠতে থাকে এসময়ে এবং অবশেষে ১৯৬৯ সালে আইয়ুবের মুখের উপর তা বিস্ফোরিত হয়। এসময়ের মধ্যে মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ হয়ে ওঠে সবচেয়ে প্রভাবশালী শক্তি। লীগের সমর্থনের মূল ঘাঁটি ছিল শহর এলাকা তবে মুজিব গ্রাম্য এলাকাতেও সমর্থন আদায়ে সক্ষম হন। এটি তার অবস্থানকে দ্যাখার মতো শক্ত করে তোলে। কেন্দ্রীয় সরকার বাঙালি অংশগ্রহণের মধ্যে হাঙ্গামা বাঁধানোর জন্য কিছু বাঙালিকে নতুন করে মনোনয়ন দ্যায়। পূর্ব পাকিস্তানের মন্ত্রী এবং গভর্নরেরা শাসকগোষ্ঠীর খেয়াল খুশি মত কাজ করতেন। তাদের কোনো জনপ্রিয়তার উৎস ছিলোনা। আইয়ুব সরকারের ১৬ জন পূর্বপাকিস্তানী মন্ত্রীর মধ্যে ৪ জন এসেছিলেন লোক প্রশাসন থেকে, একজন ছিলেন সাংবাদিক। বাকি ১১ জন ছিলেন মুসলিম লীগের দ্বিতীয় সারির নেতা। এদের মধ্যে ৮ জন ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে হেরেছেন[পূর্ব পাকিস্তানে তখন পর্যন্ত সংঘটিত একটিমাত্র পূর্ণ জনতার অংশগ্রহণে নির্বাচন]। সাত বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে এতো বাজে ভাবে হেরেছিলেন যে তার জামানত বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিলো।[৩০]

এই হলো ২৪ বছর ধরে টিকে থাকা দুটি অংশের মাঝের মৌলিক পার্থক্যের বিবরণ। এর মূল্য চরম ভাবে পরিশোধ করতে হয় ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের নতুন ভোরে।

মৃত্যুনাচন
‘দুর্ভাগ্যজনক সময়ে ঘটে যাওয়া বাড়াবাড়িগুলো দুঃখজনক’। সাভারের ১৯৭১ এ শহীদদের সম্মানে নির্মিত স্মৃতিসৌধের দর্শক বইতে জেনারেল পারভেজ মোশাররফের লেখা।[জুলাই ২০০২ সাল][৩১]

সকল চেনা খাতেই রাষ্ট্রের ভাঙন নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলো যখন ১৯৬৯ সালে ইয়াহিয়া খান রাষ্ট্রের ক্ষমতা নেন। মনস্তাত্ত্বিক বিভাগে দুটি অংশের বিচ্ছেদ সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছিলো। শুধুমাত্র সলোমনের জ্ঞানই পারতো গৃহযুদ্ধ এড়াতে কিন্তু তার বদলে ছিল নির্জলা আবেগ আর আলঙ্কারিক ভাষার মিশেলে অজ্ঞতার প্রাচুর্য। সামরিক অভিজাতেরা তাদের নিজের সমাজের গতিময়তা বুঝতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। সত্যিকারের অংশগ্রহণের অভাবে তারা উচ্চাভিলাষী কিন্তু অবাস্তব উচ্চ পর্যায়ের জাতীয় সংহতির লক্ষ্যে কাজ শুরু করে। ১৯৭১ এর মার্চে তারা একটি ভয়ংকর সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের ভিত্তি হিসেবে চিন্তাভাবনা এমন ছিলো যে এই সংঘাত হচ্ছে একেবারেই কৃত্রিম এবং তারা সরাসরি পাশবিক শক্তি দিয়ে একে আঘাত করে নিয়ন্ত্রণ করবে। পশ্চিম পাকিস্তানের সকল বেসামরিক নাগরিক[সেই সাথে বেসামরিক আমলাতন্ত্র এবং সব রাজনৈতিক দল] সামরিক দৃষ্টিভঙ্গির এই অনুমানের সাথে একাত্মতা পোষণ করে।

সাধারণ অবিশ্বাস এবং বাঙালি সংক্রান্ত বর্ণবাদী কুসংস্কারের পশ্চাতে যখন বাঙালিদের দাবী জোরালো হতে থাকলো, তখন তাদের ওপর ক্রোধও পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকলো। পশ্চিম পাকিস্তানের বেসামরিক জনগণ এবং সামরিক কর্মকর্তাদের সবার মধ্যেই এ ধারণা প্রচলিত ছিলো। ১৯৭১ সালের শুরুর দিকে খুবই কম কিছু সম্ভাব্য ব্যতিক্রম বাদে[লে. জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খান ছিলেন তাদের একজন] সামরিক নেতৃত্বের মাঝে সাধারণ চিন্তাধারা ছিলো এমন যে, শক্তির ব্যবহার ছাড়া আর কোনো সমাধান নেই।২২ ফেব্রুয়ারি ইয়াহিয়া খান গভর্নর এবং মার্শাল ল এডমিনেস্ট্রেটর[এম. এল. এ. গণ]দের নিয়ে একটি সভা ডাকেন। লে. জেনারেল ইয়াকুব খান ইয়াহিয়া খানকে শক্তি ব্যবহারে পুনর্বিবেচনা করতে অনুরোধ করেন। “তিনি মনে করেছিলেন ছররা গুলির এক ফুঁয়েই কাজ হবে এবং সামরিক আইন আবার চাপিয়ে দিলে কোনো সমস্যার সৃষ্টি হবেনা।”[৩২]

ইয়াহিয়ার ব্যাপারে নিরপেক্ষ হতে গেলে বলতে হয়, এই মূল্যায়নে তিনি একা ছিলেন না। প্রায় সকল বেসামরিক এবং সামরিক নেতাদেরও একই দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো। নেতৃত্বের সিদ্ধান্তগুলো বুঝতে গেলে সেই সময়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের চিন্তাধারাগুলোকে আমাদের বুঝতে হবে। পশ্চিম পাকিস্তানীদের উপলদ্ধি সম্পর্কে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নিয়াজি বলেন, “বাঙালিদের রাজনীতিতে হিন্দু প্রভাবের ব্যাপারটি তারাও বুঝেছে…. সরকার গঠিত হবে বাঙালিদের দিয়ে, মখমল দস্তানায় লৌহ মুষ্টি হবে হিন্দুদের। হিন্দুদের অকার্যকর করে দেয়া নিশ্চিত করার জন্য দ্বৈত প্রথা এসেছিল… হিন্দু নিয়ন্ত্রিত বাঙালিদের শোষণ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানীদের রক্ষা করার স্বার্থে এই লক্ষ্য নেওয়া হয়েছিলো।”[৩৩]

১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের নিরংকুশ বিজয়ের পরে ইয়াহিয়ার ইন্টিলিজেন্স চীফ মেজর জেনারেল আকবর খান বলেন যে, “আমরা এই বেজন্মাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবো না।”[৩৪]

১৯৭১ সালের জুনে একটি ডিভিশন কমান্ডারদের সভায় প্রায় সকল জেনারেলই আওয়ামী লীগের সাথে সমঝোতাকে নাকচ করে দ্যান এবং বলেন, “আমাদের অবশ্যই একে শেষ করতে হবে।”। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে ঢাকায় এক ভ্রমণে ইয়াহিয়ার একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী বলেন, “যতক্ষণ না ‘বিঙ্গোদের’[বাঙালিদের বর্ণবাদী অভিধা] ভালো মতো বাছাই করা হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের সাথে কোনো রাজনৈতিক মীমাংসা হবেনা।”[৩৬]

পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ বেসামরিক জনগণেরও একই চিন্তাধারা ছিলো। ভুট্টো দাবী করেছিলেন যে পাকিস্তানের ক্ষমতার মূল কেন্দ্র হলো পাঞ্জাব আর সিন্ধ। প্রশাসনের এই সাধারণ চিন্তা ছিলো যে, “ডান্ডার বাড়ির স্বাদই বাঙালি বাবুদের ভয়ে কাবু রাখতে পারে।”[৩৭]

সেই শাসনামলে যারা বেসামরিক আমলাতন্ত্রে কাজ করছিলেন যেমন তথ্য সচিব রোয়েদাদ খান জেনারেলদের উপদেশ দ্যান যে কিভাবে বাঙালিদের ‘আল্লাহর ভয় দ্যাখাতে হবে’ এবং কিভাবে বাংলা লেখনীকে আরবীয়করণ করে বাঙালি জাতি ও সংস্কৃতিকে বিশুদ্ধ করতে হবে।[৩৮]

শাসকগোষ্ঠী সম্পূর্ণ আঁধারে ছিলো এবং কোনো অর্থবহ উপায়ে সাড়া দেওয়া তো দূরের কথা, তাদের ভালোমতো বোঝার আগেই ঘটনাবলী উল্কার বেগে পরিবর্তিত হচ্ছিলো। বুটজুতার বাইরে দেখতে অক্ষম এই শাসকেরা তখন সত্যিকার অর্থেই বিকারে ভুগছিলেন। যখন বাঙালি সৈন্য, পুলিশ কর্মকর্তা, কূটনৈতিক এবং বিমান চালকেরা হাজারে হাজারে বিদ্রোহ ঘোষণা করে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করছিলেন তখন সেনাশাসনের সদস্যরা পাকিস্তানী বিশেষ বার্তাবহদের [রাষ্ট্রদূতের পরবর্তী পর্যায়ের কূটনৈতিক। মে. জেনারেল গোলাম ওমর, তথ্য সচিব রোয়েদাদ খান এবং পররাষ্ট্র সচিব সুলতান মোহম্মদ পাকিস্তানী বিশেষ বার্তাবহদের সাথে তেহরান এবং জেনেভায় দ্যাখা করেন।] পুনরায় আশ্বস্ত করছিলেন যে সবকিছু নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আছে এবং বেশিরভাগ বাঙালিই পাকিস্তানের সাথে আছে। এটা তখন বলা হচ্ছিলো যখন তারা একজন বাঙালিকেও ঢাকা রেডিও স্টেশনে কাজ করাতে পারেনি। হাস্যকর মোচড়ে, জেনেভায় অনুষ্ঠিত এক মানবাধিকার সম্মেলনে অংশগ্রহণের সময় পাকিস্তানী প্রতিনিধি[আবু সাইদ চৌধুরী] বিদ্রোহ ঘোষণা করে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করেন। তারা সত্যিই ভেবেছিলো যে গোটা পৃথিবী অন্ধ।

সাধারণ চিন্তা প্রক্রিয়া শুধুমাত্র উঁচু স্তরেই সীমাবদ্ধ ছিলোনা। সৈনিকের মনে যখন এই সমাধান পৌঁছায় যে বাঙালিরা হচ্ছে দেশদ্রোহী তখন তাদের পরবর্তী কার্যক্রম কি ছিলো তা সহজেই বোঝা যায়। দেশদ্রোহীদের সাথে কোনো সমঝোতা হয়না। দেশকে ওদের ধ্বংস থেকে বাঁচাতে হলে ওদের শেষ করে ফেলতে হবে। সৈনিকেরা এখন প্রস্তুত। তারা এমন একটি দলের সাথে মোকাবেলা করতে মানসিকভাবে প্রস্তুত যাদের দেখে আসা হয়েছে ভীতু হিসেবে এবং তাদের ওপর শুধুমাত্র বলপ্রয়োগই করতে হবে। এক অবসরপ্রাপ্ত পশতুন ক্যাভালরি অফিসার বিস্তৃতভাবে এই চিন্তা প্রকাশ করেন। ১৯৭১ এর শুরুতে একটি আলোচনায় তিনি বাঙালিদের নাকচ করে দ্যান ভীতু হিসেবে এবং ভবিষ্যৎবাণী করেন যে প্রথম গুলিটি ছোঁড়া হলেই তারা দৌড়ে পালাবে। তিনি আত্মবিশ্বাসের সাথে জানান, “আপনি কি জানেন একটিমাত্র আর্মার্ড রেজিমেন্ট বাংলায় কি করতে পারে? মাখনের মধ্যে ছুরি যাওয়ার মতো এটি বাঙালিদের মধ্য দিয়ে চলে যাবে।[তিনি হেয় করে 'বিঙ্গো' শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন।]“[৪০]

যখন সামরিক প্রক্রিয়া শুরু হলো তখন যা মনে হয়েছে তা দিয়েই বেশিরভাগ কর্মকর্তা এবং নিম্নপদস্থ সৈনিকেরা তাদের কাজকে ন্যায্য হিসেবে দেখিয়েছে। ১৬ ডিভিশনের হেডকোয়ার্টারে এন্থনি মাসকারেনহাসকে বলা হয়েছিলো, “এমনকি যদি ২ মিলিয়ন মানুষকে হত্যা করতে হয় এবং পুরো প্রদেশকে ৩০ বছর ধরে উপনিবেশ বানিয়ে শাসন করতে হয়, তারপরেও আমরা পূর্ব পাকিস্তানকে একেবারে সব বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হুমকি থেকে পরিষ্কার করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।” [৪১]

কুমিল্লার ৯ ডিভিশনের হেডকোয়ার্টারে মেজর বশির সামরিক প্রক্রিয়াকে ন্যায্য হিসেবে দেখিয়েছিলেন এই বলে যে বাঙালি মুসলিম ‘সর্বান্তকরণে’ হিন্দু ছিলো এবং এটি হলো বিশুদ্ধ এবং দূষিতদের মাঝে যুদ্ধ। তার জ্যেষ্ঠ কর্নেল নাঈম হিন্দু বেসামরিক জনগণ হত্যাকে বাঙালির ব্যবসা-বাণিজ্য এবং সংস্কৃতিকে হিন্দুদের হাত থেকে নিয়ে নেওয়ার জন্য ন্যায্য হিসেবে দেখিয়েছিলেন।[৪২]

খুলনায় একজন উঁচু পদের কর্মকর্তা রয়টারের মরিস কুইন্ট্যান্সকে বলেছিলেন, “এই এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিতে আমার পাঁচ দিন লেগেছে। আমাদের পথের সামনে যারা এসেছে আমরা তাদের সবাইকে হত্যা করেছিলাম। আমরা কখনোই মৃতদেহ গোনায় কোনো গরজ বোধ করি নাই।”[৪৩]

মার্চ অপারেশনের পরে ক্যাপ্টেন চৌধুরী মন্তব্য করেন যে, “কমপক্ষে একটি প্রজন্মের জন্য বাঙালিদের ভালো মত সিধা করে বাছাই করে দেওয়া হয়েছে।” মেজর মালিক এই মূল্যায়নে সম্মত হয়ে উক্তি করেছিলেন যে, “হ্যাঁ, তারা শুধু শক্তিপ্রয়োগের ভাষাই জানে। তাদের ইতিহাস তাই বলে।”[৪৪]

গৃহযুদ্ধ এবং বিচ্ছিন্নতাবাদ খুবই পাশবিক এবং সহিংস। তারা এক দুষ্টচক্রে তাদের পথ চলে। ১৯৭১ সালের মার্চ অপারেশনে বিপুল সংখ্যক বেসামরিক বাঙালি নিহত হয়। সুসংহত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কিছু করার মতো অবস্থায় না থাকার কারণে বাঙালিদের সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ে তাদের মধ্যে থাকা অবাঙালি সমাজের ওপর। হত্যা, ধর্ষণ এবং সম্পূর্ণ ধ্বংসের এক ভয়াল অভিযান হইয়েছিলো বেসামরিক অবাঙালি জনগণের ওপর। এই নৃশংসতা সেনাবাহিনীর ওপরে ক্রোধের বন্যা বইয়ে দিয়েছিলো। বাঙালিদের বিদ্রোহের দাম চরম মূল্যে তোলার জন্য তারা একেবারেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিলো। দুই অংশের জনতার সংগৃহিত ইতিহাসের সবচেয়ে লজ্জাজনক এবং বিষাদময় অংশ হলো এই লাগামছাড়া রক্তপাত এবং বেসামরিকদের ওপরে জঘন্য নৃশংসতা। যে কারো দায়িত্বজ্ঞানহীন হত্যার বিচার হওয়া উচিত। আমজনতার চেয়ে উঁচু মান বজায় রাখা সংস্থার ক্ষেত্রে ব্যাপারটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাঙালিদের দিক থেকে কেউ কেউ নৃশংসতার অতিরঞ্জিত বর্ণনা দিয়েছেন যেখানে পাকিস্তানের দিক থেকে পুরো ব্যাপারটিকে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করা হয় যা আরো বিশৃংখলার সৃষ্টি করে। অথচ পরিকল্পিত এবং নিঁখুত প্রক্রিয়ায় বেসামরিক জনতার হত্যাকে দ্যাখানোর জন্য পর্যাপ্ত প্রমাণ আছে, বিশেষ করে শিক্ষিত বুদ্ধিজীবি সম্প্রদায় এবং হিন্দু বেসামরিক জনতাকে হত্যার।[৪৫]

জ্যেষ্ঠ পাকিস্তানী অফিসাররা সেটি দেখিয়ে দ্যান। নিয়াজি পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃত্বের ওপর অনুমানে সকল বাহিনীর কাছে একটি গোপন নির্দেশাবলী পাঠান যেখানে লেখা ছিলো, “আমার আসার পর থেকে আমি অসংখ্য সেনাদের লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, নির্বিচারে এবং বিনা কারণে বিভিন্ন এলাকায় দেশদ্রোহীদের নির্মূলের জন্য হত্যার রিপোর্ট পেয়েছি। পরে ধর্ষণেরও অসংখ্য রিপোর্ট পাওয়া গেছে… এরকম কথা উঠেছে যে পশ্চিম পাকিস্তানে ফেরত যাওয়া পরিবারের মাধ্যমে লুটের মাল পাঠানো হয়েছে।”[৪৬]

একজন প্রাক্তন ব্রিগেডিয়ার বলেন যে ফরমান আলী শক্তির মাধ্যমে বাঙালিদের ধ্বসিয়ে দেয়ার পরিকল্পনার মুখ্য স্থপতি ছিলেন এবং হিন্দু বস্তিতে গণহত্যায় সরাসরি যুক্ত ছিলেন।[৪৭] নিয়াজি এটাও স্বীকার করেন যে টিক্কা খানের দ্বারা ‘পোড়ামাটি নীতি’ বাস্তবায়ন করা হয়েছিলো; তার ‘আমি মাটি চাই, মানুষ না’ নীতি মে. জেনারেল ফরমান এবং ব্রিগেডিয়ার জেহানজেব আরবাবের মানসিক প্ররোচনা দ্বারা ঢাকায় বাস্তবায়িত হয়েছিলো। তিনি আরো স্বীকার করেন যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের বিরুদ্ধে ট্যাংক এবং মর্টার ব্যবহার করা হয়েছিলো এবং আরবাবের নেতৃত্বে ৭ ব্রিগেড ঢাকায় শুধু হত্যাযজ্ঞই চালায়নি সেইসাথে ব্যাংক ও অন্যান্য জায়গায় লুটপাটও করেছে।[৪৮]

মোট সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন দলে বিতর্ক হতে পারে তবে এই সত্য তবুও বজায় থাকে যে ২৫ মার্চের সামরিক অপারেশনের পর থেকে বিপুল অংকের হত্যা এবং ধ্বংসযজ্ঞ চলেছে। এ সমাধানে পৌঁছার জন্য পাকিস্তানী এবং বাঙালি দুই দিকেই যথেষ্ট পরিমাণে তথ্য রয়েছে।

সামরিক দিক
সামরিক বাহিনী তার প্রকৃতিগত ভাবেই সমালোচনার প্রতি অত্যন্ত স্পর্শকাতর যা এর ভুল এবং অপর্যাপ্ততা থেকে শিক্ষা নেওয়াকে খুবই কঠিন করে তোলে।[৪৯]

কোনোরকমের একনিষ্ঠ আলোচনা এবং বিতর্ক ছাড়াই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের একটি ছোট্ট দল দিয়ে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা নীতি গড়ে ওঠে। জ্যেষ্ঠ সামরিক অভিজাতদের দ্বারা দাবিয়ে রাখা পশ্চিম পাকিস্তান ‘পশ্চিম পাকিস্তানকে দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে রক্ষার’ ধারণা গ্রহণ করে। এর উৎস ছিলো ইংরেজ সংস্কৃতি। দেশভাগের আগে ভারতীয় বাহিনীর সি. ইন. সি. ফীল্ডমার্শাল ক্লড এচিনলেক পূর্ব পাকিস্তানকে ‘কৌশলগতভাবে মূল্যহীন’ হিসেবে ধরে নেন। তার পর্যবেক্ষণে দেশটির সমতল ভূমি এবং আক্রমণের সহজ টার্গেট ছিলো এর কারণ; বাঙালিদের যুদ্ধের সংস্কৃতি ছিল নগণ্য এবং এখানে খুব কম প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে এবং কোনো মূল্যবান কারখানাও নেই। কাজেই তিনি এই সমাধানে পৌঁছান যে পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিরক্ষা বিনিয়োগে কোনো দূরদর্শীতা নেই।[৫০]

১৯৪৭ সালের এপ্রিলে এচিনলেক পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ধারণায় লেখেন যে, “এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক এবং কৌশলগত মূল্য বিবেচনা করলে আগ্রাসন থেকে একে রক্ষার জন্য পর্যাপ্ত প্রতিরক্ষা প্রদান করতে যে প্রচেষ্টা দরকার তা একেবারেই অনুপাতের বাইরে।”[৫১]

উপনিবেশ হিসেবে দেখলে এই মূল্যায়ন হয়তোবা সঠিক, কিন্তু একটি স্বাধীন দেশ যখন এই নীতি গ্রহণ করে যেখানে তার সবচেয়ে বেশি জনগণের এলাকাকে ধরা হচ্ছে মূল্যহীন তখন তা নিছকই ফালতু ধারণা। এই নীতি গ্রহণ করার মানে হলো দেশের একটি অংশ আরেকটি অংশকে বলছে, তোমরা ‘মূল্যহীন এবং প্রতিরক্ষার অযোগ্য’। কাজেই আমরা তোমাদের দেশকে শত্রুদের দ্বারা দখল করতে দেবো আর অন্য কোথাও তাদের হারাবো। এরপরে আলোচনায় বসে আমরা তোমাদের স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবো। সামরিক বাহিনীর ইতিহাসে এমন কোনো ফালতু উদাহরণ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। সকল জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের কাছে এচিনলেকের মর্যাদা ছিলো খুবই উঁচুতে। এদের কেউ কেউ তার অধীনে কাজ করেছেন এবং তার কথা এবং ধারণাকে বেদবাক্যের মত সত্য বলে মানতেন। এই একটি উদাহরণ গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের স্বাধীন চিন্তা এবং পুংখানুপুংখ বিশ্লেষণের অভাবকে দেখিয়ে দ্যায়। এই বিষয়ে যেকোনো একনিষ্ঠ আলোচনাকে আইয়ুব নিরুৎসাহিত করতেন।[এই ইস্যুতে আলোচনা করতে চাওয়ার জন্য রেগেমেগে নৌবাহিনীর চীফ ভাইস এডমিরাল এইচ. এম. এস. চৌধুরীর পদত্যাগের সুপারিশ করে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি চিঠি লেখেন।] উঁচু পদে বাঙালি অফিসারদের অনুপস্থিতিতে এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করার মতো কেউই ছিলেননা। ঐ অঞ্চলকে মাতৃভূমি হিসেবে মনে করার মত কেউই ছিলেন না যে প্রতিরক্ষার ব্যাপারে একটি বিকল্প মতামত উপস্থাপন করতে পারেন। ভারত পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণ করলে পাকিস্তান তার প্রতিক্রিয়ায় কি করবে সে ব্যাপারে জেনারেল হেডকোয়ার্টারের[জি. এইচ. কিউ.] কোনো সুচিন্তিত পরিকল্পনা ছিলোনা। সবকিছু ফিরে দ্যাখার পরেও ২০০১ সালে একজন প্রাক্তন পাকিস্তানী জেনারেল এখনো জোরালোভাবে বলেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানকে দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষার নীতিটি একটি দারুণ নীতি ছিলো। তিনি যুক্তি দ্যাখান যে, পশ্চিম পাকিস্তান ‘মর্মস্থল’ এবং ‘শিল্পকারখানা এবং সামরিক শক্তির কেন্দ্রবিন্দু’ ছিলো।[৫২]

একটি দেশের কোনো দলই তাদের ‘কৌশলগত ভাবে মূল্যহীন’ বা ‘প্রবেশ পথ’ হিসেবে দেখতে চায়না। এর ফলে তারা হস্তান্তর যোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয় যখন অন্যরা ‘কেন্দ্র’ ও ‘মর্মস্থলে’ যুদ্ধ করে মরার জন্য উচু মর্যাদা পায়। এই শ্রদ্ধেয় এবং দেশপ্রেমিক সেনানীরা এই মৌলিক সত্যটি বুঝতে ব্যর্থ। ভারতের সাথে ১৯৬৫ সালের যুদ্ধ ‘পশ্চিম পাকিস্তানকে দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান প্রতিরক্ষা’ ধারণার অন্তঃসারশূন্যতা খোলাখুলি দ্যাখিয়ে দ্যায়। পশ্চিম ফ্রন্টে উন্নত পাকিস্তানী সরঞ্জাম থাকা সত্ত্বেও কোনো বিশেষ আঞ্চলিক দখল ছাড়াই পাকিস্তান সরাসরি হেরে বসে। পূর্ব পাকিস্তানের মাত্র একটি কমজোর ডিভিশন[মে. জেনারেল ফজল মুকিম খানের অধীনে ১৪ ডিভিশন] আর ১৫টি স্যাবর জেট ছিলো। দুই অংশের সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছিলো। পূর্ব পাকিস্তান ছিলো অরক্ষিত। এটি বাঙালিদের মাঝে নিরাপত্তাহীনতা বৃদ্ধি করার সাথে এই তিক্ততারও জন্ম দ্যায় যে কাশ্মীর অঞ্চল দখলের জন্য তাদেরকে ভারত দ্বারা দখলের ঝুঁকিতে রাখা হয়েছে।[৫৩]

১৯৬৫ সালের যুদ্ধের ক্ষয়-ক্ষতি সামরিক নয় বরং রাজনৈতিক। আমার মতে, ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পরেই বাঙালিরা গণহারে একটি একক কেন্দ্রীয় সরকারের মাধ্যমে দুটি অংশের সমন্বয় নিয়ে প্রশ্ন তুলতে থাকে। ১৯৭১ এর শুরুর দিকে পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে। পূর্বাংশে দুটি ডিভিশন[৯ এবং ১৬] পাঠাতে পাকিস্তানী জি. এইচ. কিউ. বাধ্য হয়। দেশের কৌশলগত সঞ্চয় ছিলো এই দুটি ডিভিশন। সঞ্চয়ের পুনর্বহাল করতে আরো দুটো ডিভিশন ওঠানো হয়। এভাবে ১৯৭১ সালের নভেম্বরের যুদ্ধের সময় রিজার্ভ ডিভিশন ছিলো শৈশব পর্যায়ে। বাঙালি বিচ্ছিন্নতাবাদ বিষয়ে পাকিস্তানী জি. এইচ. কিউ. এর একেবারেই শিশুসুলভ সরল মনোভাব ছিলো। তারা বুঝতে পারেনি যে রাজনৈতিক সমস্যা সেনাবাহিনীর কৌশলগত ভারসাম্যের ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলবে।[৫৪]

অনেক আগেই ১৯৫৮ সালে ঢাকার মার্কিন কনসুলার পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক সমস্যা পরিষ্কার ভাবে দেখেছিলেন, এমনকি আইয়ুব খানের ক্যু এর কয়েক মাস আগেই। ২৯ মে ১৯৫৮ সালে স্টেট ডিপার্টমেন্টে পাঠানো এক টেলিগ্রামে তিনি লেখেন, “পূর্ব পাকিস্তানকে ধরে রাখতে একজন স্বৈরশাসককে এখানে সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করতে হবে। এখন মাত্র একটি কমজোর ডিভিশনে দুটি বাঙালি ব্যাটেলিয়ন আছে যারা বিদ্রোহ করতে পারে। এখানে সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করার মানে হলো পশ্চিম পাকিস্তানে একে দূর্বল করা। সেনাবাহিনী এখানে মনে করে যে তারা আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে। কিন্তু এই হিসাব শুধু দাঙ্গা আর আভ্যন্তরীণ গোলযোগের ওপর ভিত্তি করে, অন্য দেশের সাহায্যে সরাসরি বিদ্রোহ বা এরকম কোনো কিছুর ওপর ভিত্তি করে নয়। আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতা এবং অন্যান্য দেশ থেকে আমরা জানি যে গৃহযুদ্ধ খুবই তিক্ত এবং ক্ষমাহীন।”[৫৫]

পাকিস্তানী নেতৃত্বের এরকম দূরদৃষ্টি দেখতে পাওয়া খুবই দুর্লভ।

একটি বহুজাতিক রাষ্ট্রে সেনা শক্তিতে বিভিন্ন অংশের সংখ্যা সমাজের বৃহত্তর অংশে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই প্রভাবই ফেলে। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে এটি আরো গুরুত্বপূর্ণ। এখানে সেনাবাহিনী একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে সরাসরি রাষ্ট্র শাসনের সাথে যুক্ত। ইংরেজ সেনাবাহিনীর ধারাবাহিকতা হলো পাকিস্তান সেনাবাহিনী। স্বাধীনতার সময় পাকিস্তানের সামরিক শক্তিতে বাঙালিদের প্রায় পুরোপুরি অনুপস্থিতির কারণ ছিলো সেনাবাহিনীতে বাঙালিদের তুলনামূলকভাবে কম যোগদানের ইচ্ছা আর ইংরেজদের ‘যুদ্ধপ্রিয় জাতি’ তত্ত্ব এই দুটি উপাদান। অল্প কয়েকটি জাতিগোষ্ঠি দ্বারা দাবিয়ে রাখা সেনাবাহিনীর দৃষ্টিভঙ্গিতে একে দ্যাখা হতো ‘নির্দিষ্ট অঞ্চলের স্বার্থের জন্য হাতিয়ার’ হিসেবে। আর যখন সামরিক শক্তি নিজেদের দেশের নেতৃত্ব মনে করে তখন এই ভাবমূর্তি আরো অবনতির দিকে যেতে থাকে।[৫৬]

দেশটির প্রতিষ্ঠাতা মুহম্মদ আলী জিন্না বাঙালি রেজিমেন্ট গড়ে তোলার নির্দেশ দ্যান। ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারীতে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট[EBR] এর প্রথম ব্যাটেলিয়ন গঠন ঙ্করা হয়। এর সাধারণ নাম ছিলো সিনিয়র টাইগার্স। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর দ্বিতীয় ব্যাটেলিয়ন গঠন করা হয় ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বরে। বাঙালিদের অন্তর্ভুক্ত করার এ নীতি কোনোমতে শেষ করা হয়। ১৯৬৮ এর শুরুতে মাত্র চারটি বাঙালি রেজিমেন্ট ছিলো। এর অনেকগুলো কারণ ছিলো। বহুজাতিক সমাজে যখন একটি দাবিয়ে রাখা অংশ জাতীয় নিরাপত্তা আর দেশপ্রেমের সংগার মাত্রা নির্ধারণ করে তখন অন্য যে অংশের ভিন্ন মত থাকে, তাদের ধরা হয় কম দেশপ্রেমিক। যদি বাঙালির সামরিক শক্তিতে যোগদানের ইচ্ছা অপেক্ষাকৃত কম থাকে[এর ঐতিহাসিক, সামাজিক বা সাংস্কৃতিক কারণ থাকতে পারে।], তাহলে ধরে নেওয়া হয় যে সে কম দেশপ্রেমিক এবং দেশের প্রতি তার আনুগত্য সন্দেহজনক। এর মানে হলো তার যোগদানের ইচ্ছা থাকলেও সে সংস্থাটিতে আমন্ত্রিত নয়। এ অবস্থায় সাধারণ নীতিটি দাঁড়ায়, যে অংশটি দেশ বা শাসনের প্রতি কম আনুগত্যশীল তাদেরকে বাহিনীতে এমনভাবে দেরীতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে যাতে করে রাজনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি অভিজাতদের জন্য সহনশীল হয়।[৫৭]

পাকিস্তানী নেতৃত্ব বাঙালিদের ক্ষেত্রে ঠিক এটাই করেছিলো।

ইংরেজদের ‘বাঙালিদের যুদ্ধভীরু জাতিতত্ত্ব’ পাঞ্জাবি ও পশতুন[পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে দাবিয়ে রাখা অংশ] অফিসারদের মধ্যেও জনপ্রিয় ছিলো। বিমানবাহিনী এবং নৌবাহিনীতে বাঙালিদের সংখ্যা মাত্রিক হারে বেড়েছিলো। এর অনেক কারণ আছে। সেনাবাহিনীর সাথে তুলনায় এদুটি বাহিনী রাজনৈতিক ক্যু এর সাথে অনেক কম জড়িত ছিলো। দ্বিতীয়ত, যন্ত্রপাতি চালানোর জন্য প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং উঁচু শিক্ষামানের দরকার ছিলো এ দুটি বাহিনীতে। বাঙালিদের সে দক্ষতা ছিলো। কাকুল মিলিটারী একাডেমীতে বাঙালি ক্যাডেটদের ‘যুদ্ধপ্রিয় জাতিদের’ চেয়ে নীচু মানের ধরা হতো। ১৯৫০ সালের একাডেমীর একজন প্রাক্তন ইন্সট্রাক্টর বলেন যে বাঙালিদের ঢালাওভাবে খারাপ গ্রেড দেওয়া হতো এবং খুব কমই উঁচু পদে নিয়োগ দেওয়া হতো। তাদের অনেককেই ‘ফুলবাবু’ হিসেবে বাতিল করা হতো।[৫৮]

বাঙালি ও অবাঙালি অফিসারদের মধ্যে বিভেদরেখা দুটি অংশের জনতার মতই সুদুরপ্রসারিত ছিলো। বাঙালি মনমানসিকতাকে সম্পূর্ণ তাচ্ছিল্য করার পরিমাপক হিসেবে এই উদাহরণটি দ্যাখা যেতে পারে। ১৯৭০ সালে কাকুলে এক নৈশভোজে একজন বাঙালি ক্যাডেটের সাথে একই টেবিলে মেজর সাব্বির শরিফ [ভালো ও শ্রদ্ধাভাজন অফিসার, পরে ১৯৭১ সালে ফ্রণ্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টে সুলেমানকি সেক্টরে যুদ্ধরত অবস্থায় মারা যান।] ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ভয়াল জলোচ্ছাস নিয়ে তিনি মন্তব্য করেন যে একশ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গেছে। তিনি তারপর যোগ করেন, ওখানে এতোবেশি বাঙালি আছে যে‘I’m sure they will not be missed’ (আমি নিশ্চিত তাদের অভাব বোঝা যাবেনা।)। যে মানুষটি অনেক তরুণ ক্যাডেটের আদর্শ এবং সবাই যাকে অনুকরণের জন্য উদগ্রীব সেই অফিসারের মুখে এমন কথা শুনে তরুণ বাঙালি ক্যাডেট স্তম্ভিত হয়ে যান।[৫৯]

১৯৬৯ সালে ইয়াহিয়া খান নতুন বাঙালি রেজিমেন্ট গঠন করার নির্দেশ দ্যান। আর সব সিদ্ধান্তের মতো এতেও অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিলো। সেসময়ের মধ্যে বাঙালিরা অনেক বেশি রাজনীতিআচ্ছন্ন এবং বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলো। পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য রেজিমেন্টের সাথে তুলনা করলে EBR এ অন্যান্য জাতিগোষ্ঠির মিশ্রণ ছিলোনা। বাঙালি রেজিমেন্টের এই একক শ্রেণীটি নিশ্চিত করেছিলো যে যখনই কোনো বাঙালি ইউনিট বিদ্রোহ করবে, তখন তা হবে গণহারে। ১৯৭১ এর মার্চে ঠিক তাই হয়েছিলো। যখনই কোনো EBR বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে তাদের প্রথম কাজটিই ছিলো পশ্চিম পাকিস্তানী সমস্ত অফিসারদের হত্যা করা। এর মানে ‘কারোরই ফেরার উপায় নেই’। ফলে সবচেয়ে অনিচ্ছুকও বিদ্রোহীদের এককাতারে শামিল হতো। এর সাথে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের অদ্ভুত মিল আছে। ১৯৭১ সালের মার্চ অপারেশনের পরে পূর্ব পাকিস্তানে থাকা বাঙালি অফিসার ও সৈন্যরা গণহারে বিদ্রোহ করেন এবং হাতের কাছে যে হাতিয়ার পান তা নিয়ে পালিয়ে যান। এরাই পরে মুক্তিবাহিনীর শক্তিকেন্দ্র গঠন করেন। চাঁদপুরে ১ EBRকে তাৎপর্যপূর্ণভাবে কমানো হয়েছিলো। এই রেজিমেন্টকে যশোরে সরানো হয়। সেখানে নিরস্ত্র করার সময় কিছু সৈন্য অস্ত্রহাতে পালাতে সক্ষম হয়। জয়দেবপুরে ২৮-২৯ মার্চের রাতে ২ EBR বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং অস্ত্রপাতি সহ পালিয়ে যায়। ঘোড়াঘাট এবং গাইবান্ধায় ৩ EBRএর দুটি কোম্পানি বিদ্রোহের পর হিলি এলাকায় সরে যায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং শমসেরনগরে ৪ EBR বিদ্রোহীদের সাথে যোগ দেওয়ার জন্য সিলেট এলাকায় সরে যায়। চট্টগ্রামের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের[সেসময় ৯ EBR গঠন করা হচ্ছিলো।] প্রশিক্ষণার্থীরা মার্চ ২৫-২৬ এর রাতে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। ১০ EBR[ন্যাশনাল সার্ভিস ব্যাটেলিয়ন নামের আরেকটি নবগঠিত ব্যাটেলিয়ন।]এও পলায়ন ঘটে। বাকিদের ছুটিতে পাঠানো হয়। প্যারামিলিটারি বাহিনী, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস[EPR] এর মোট ১৭,০০০ জনের মধ্যে মাত্র ৪,০০০ জনকে নিরস্ত্র করা সম্ভব হয়। বাকিরা অস্ত্রসমেত ক্যাম্প ত্যাগ করে।[৬০]

বাঙালি সেনাবাহিনী, আধাসামরিক বাহিনী এবং পুলিশ কর্মচারীদের ভারতীয় সেনাবাহিনী সংগঠিত করে। মুক্তিবাহিনীর কার্যক্রমের ছদ্মনাম ছিলো ‘অপারেশন জ্যাকপট’। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ত্যাগী একেকজন মেজরের নেতৃত্বে গোটা দেশকে আটটি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছিলো। ভারতের পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণের সময় বাঙালি বাহিনী তিনটি ব্রিগেডে সজ্জিত ছিলো এবং বিভিন্ন সেক্টরে ভারতীয় বাহিনীর সাথে যুক্ত ছিলো।[৬১]

পশ্চিম পাকিস্তানে সামরিক বাহিনীতে ২৮,০০০ জন বাঙালি কর্মচারী ছিলেন। এই অংশটি একটি কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে আটকে পড়ে। কিছু অফিসার ভারতে পালিয়ে যান। পাকিস্তান সরকার পড়লো উভয় সংকটে। কোনো বাঙালি অফিসারকে বিশ্বাস করাও যাচ্ছেনা আবার বিদ্রোহের কোনো লক্ষণ না দ্যাখালে কিছু করাও যাচ্ছেনা। ফলাফল হিসেবে কিছু অবাস্তব সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। একটি ক্ষেত্রে, এক বাঙালি অফিসারকে ভারতীয় বাহিনীকে আক্রমণ করার জন্য ফ্রন্টলাইনে একটি প্লাটুনের দায়িত্ব দেওয়া হলো কিন্তু কোনো ব্যক্তিগত অস্ত্র দেওয়া হলোনা। এই অস্বাভাবিক আচরণের কারণ জানতে চাইলে লজ্জিত কমান্ডিং অফিসার তাকে জানান, “তোমার কমান্ডে যাবতীয় মেশিনগান এবং এন্টি-ট্যাংক উইপন আছে। তোমার পার্সোনাল উইপনের কি দরকার?” রেজিমেন্টের অন্যান্য অবাঙালি অফিসারদের কেন ব্যক্তিগত অস্ত্র রেখেছে এব্যাপারে কোনো যুক্তি দিতে তিনি ব্যর্থ হন।[৬২]

অস্ত্রবিরতির পর তাদের কারাগারে আটক রাখা হয়। অথচ ভুল সময়ে ভুল জায়গায় উপস্থিত থাকা ছাড়া তারা আর কোনো অপরাধ করেননি। পরে ভারতের সাথে সমঝোতার জন্য তাদের দাবার গুটির মতো ব্যবহার করা হয়।

উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের জন্য পেশাদারিত্বের প্রতি একনিষ্ঠ আনুগত্য এবং মুক্ত চিন্তার সাথে উন্নত প্রশিক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অস্বাভাবিক মনোভাবের পর্যবেক্ষণের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণ কৌশল থাকা উচিত। সামরিক বাহিনীতো অনেক দূরের কথা যেখানে জীবন-মৃত্য জড়িত; আবেগী, অতিরঞ্জিত এবং অযৌক্তিক চিন্তার জায়গা কোনো প্রতিষ্ঠানেই নাই। যুদ্ধকৌশল নিয়ে আমি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের চিন্তাভাবনার কিছু উদাহরণ দেবো যার বিবেচনার ভার পাঠকের উপরেই ছেড়ে দিলাম। ১৯৭১ সালের জুনে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে উপস্থাপিত পূর্ব মঞ্চের কমান্ডার লে. জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজির নিজের ভাষায় পরিকল্পনাটি ছিলো,[যখন তিনি নিজের জনতার সুতীব্র বিদ্রোহের মুখোমুখি এবং যখন কোনো ভারী অস্ত্র এবং বিমানবাহিনীর সাহায্য নেই।], “…. আমি আগরতলা এবং আসামের একটি বড় টুকরো দখল করতাম এবং ভারতীয় বাংলায় অসংখ্য ঝাঁকি দিতাম। হুগলি নদীর সেতু উড়িয়ে, নৌকা-জাহাজ ডুবিয়ে এবং বেসামরিক জনতার মধ্যে ভীতিসঞ্চার করে আমরা কলকাতার অর্থনীতি খোঁড়া করে দিতাম। একটিমাত্র বিমান হামলাই কলকাতার অসংখ্যমানুষকে এলাকাত্যাগে বাধ্য করতো।”[৬৩]

কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তার সামনে ১৯৭১ সালের গ্রীষ্মে নিয়াজিকে যুদ্ধকৌশল সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি একথা বলেন, “আপনারা নিয়াজি করিডোর তত্ত্ব সম্পর্কে শোনেননি? আমি ভারতে ঢুকে গঙ্গার ওপর দিয়ে মার্চ করতে করতে দিল্লী দখল করবো এবং এভাবে পাকিস্তানের সাথে জোড়া লাগাবো। এটা হবে পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানকে এক করার করিডোর। কায়েদ-ই-আজম এই করিডোর দাবী করেছিলেন এবং আমি তা অস্ত্রশক্তি দিয়ে অর্জন করবো।”[৬৪]

১৯৭১ সালে বিমানবাহিনীর করুণ অবদানের ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে প্রাক্তন বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার মার্শাল জামাল আহমেদ খান গর্ব করে বলেন, “সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতকে সমর্থন না দিলে পাকিস্তান বিমানবাহিনী ভারতীয় বিমানবাহিনীকে খোঁড়া করে দিতো।”[৬৫]

কাজে চালানোর মতো কোনো এয়ারফীল্ড না থাকায় আত্মসমর্পণের সাত দিন আগেই ডিসেম্বরের ৮ ও ৯ তারিখে পূর্ব পাকিস্তান থেকে সবগুলো যুদ্ধবিমান [সব মিলিয়ে ১৪টি] সরিয়ে নেয় পাকিস্তান। এই নগ্ন সত্যের উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও প্রাক্তন বিমানবাহিনীপ্রধান ঐকথা বলছেন। প্রয়োজনীয় রসদের অভাবে পশ্চিমাংশে বিমানবাহিনী সেনাবাহিনীকে কোনো অর্থবহ সমর্থন দিতে বা পর্যাপ্তভাবে শহরগুলো রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়।[৬৬]

নিজের কাজ বিষয়ে সম্পূর্ণ দায়িত্বজ্ঞানহীনতা আর পেশাদারিত্বের সাথে ব্যাপক সমঝোতার মাধ্যমে বেসামরিক ব্যাপারে নাকগলানোর প্রবণতা এই চিন্তাধারা থেকে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়।

উর্দিপরা অফিসারদের দায়িত্ব এবং অদায়িত্বসুলভ কাজের জন্য অভিযুক্ত করা হলো পাকিস্তানের সবচেয়ে কঠিন কাজ। যখন প্রত্যেকে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সুরক্ষিত তখন এর সরাসরি ফলাফল হলো সেনাবাহিনীর সম্মানে এর যাবতীয় অপকর্মের অস্বীকার করা। দূর্ভাগ্যজনকভাবে কাউকে শাস্তি দেওয়া তো দূরে থাক এই শোকাচ্ছন্ন ঘটনার জন্য কাউকে অভিযুক্ত পর্যন্ত করা হয়নি। হিসাবনিকাশের পর জুলফিকার আলি ভুট্টো পাকিস্তানের শক্তিশালী প্রধান নির্বাহী হন। কাজেই তার ভূমিকার ব্যাপারে আর কে প্রশ্ন তুলতে যাবে? সেনাশাসনের সাথে যুক্ত প্রচুর বেসামরিক আমলাও একই নিরাপত্তা উপভোগ করেন। তাদের কেউই কোনোপ্রকারের বিবেকদংশন অনুভব করেননি। এমনকি তাদের কাজের এই দায়িত্বজ্ঞানহীনতার তিল পরিমাণও স্বীকার করেননি। ইয়াহিয়া খানের তথ্যসচিব জনাব রোয়েদাদ খান ধাপে ধাপে পদোন্নতির মই বেয়ে উঠে সর্বোচ্চ পদের সমস্ত সুবিধা ছেঁকে নিয়ে পদত্যাগ করেন। জনাব গোলাম ইসহাক খান ভুট্টোর সমাজতন্ত্র এবং জিয়ার ইসলামিয়করণের প্রচারণা অনায়াসে চালান এবং শেষমেশ বেশ কিছুদিনের জন্য প্রেসিডেন্ট হাউসে জায়গা পান। একটি সংস্থা হিসেবেও সামরিক বাহিনী এক্ষেত্রে ব্যর্থ। যদি কেউ এরকমও মনে করে যে কোনো বিশেষ ব্যক্তির কোনো দোষ নাই, তারপরেও স্বাভাবিক সৌজন্যতা দাবী করে যে এরকম দূর্যোগের কারণে তার সম্মানের সাথে দৃশ্যপট থেকে সরে যাওয়া উচিত এবং অন্য কাউকে দায়িত্ব গ্রহণ করতে দেওয়া উচিত। অভিযুক্ত করার বদলে ১৯৭১ এর বিয়োগান্তক নাটকের অনেক মূখ্য খেলোয়াড়েরা পদোন্নতির মাধ্যমে উপরে ওঠেছেন এবং অবসরের পর বিলাসবহুল বাড়ি পেয়েছেন। ইয়াহিয়া খান গৃহবন্দী অবস্থায় মারা যান। তার কৃতিত্ব হলো সত্যের সামনে দাঁড়িয়ে এবং জাতিকে অস্ত্রবিরতি সম্পর্কে বলার সময় তিনি বলেন, “দায়দায়িত্ব সম্পূর্ণ আমার এবং আমি তা কারো ঘাড়ে চাপাতে যাচ্ছি না। আমি এটা করবো, জনপ্রিয় হোক বা নাহোক।”[৬৭]

চীফ অফ জেনারেল স্টাফ[CGS] লে. জেনারেল গুল হাসান কিছুকালের জন্য C-in-C হন এবং বরখাস্তের পর অস্ট্রিয়ায় রাষ্ট্রদূতের পদ গ্রহণে সম্মত হন। বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার মার্শাল রহিম খান গ্রীসে রাষ্ট্রদূত হন। লে. জেনারেল টিক্কা খান[পূর্ব পাকিস্তানের অপারেশন সার্চলাইটের স্থপতি] চীফ অফ আর্মি স্টাফ[COAS] পদে পদোন্নতি পান। মে. জেনারেল রহিম খান[আত্মসমর্পণের ঘন্টাখানেক আগে নেতৃত্বদান করা অবস্থায় বার্মায় হেলিকপ্টারে চড়ে পালিয়ে যাওয়ার জন্য অভিযুক্ত।] বার্মা থেকে ফিরে এসে CGS হন। অবসরের পর তিনি প্রতিরক্ষা সচিব এবং পরে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনের চেয়ারম্যান পদে কাজ করেন। মে. জেনারেল রাও ফরমান আলী[পূর্ব পাকিস্তানে শেনাশাসনের সময় রাজনৈতিক উপদেষ্টা] ফৌজি ফাউন্ডেশনের ম্যানেজিং ডিরেক্টর হন। ১৯৭৭ সালের জুলাইয়ে জেনারেল জিয়া গঠিত ইলেকশন সেলেও তিনি পূর্ব পাকিস্তানে ব্যবহার করে শাণিত করা রাজনৈতিক কৌশলের দক্ষতা ব্যবহারে কাজ করেন। ডিরেক্টর জেনারেল অফ ইন্টার সার্ভিস ইন্টিলিজেন্স[DG ISI] মে. জেনারেল আকবর খান যুক্তরাজ্যে হাই কমিশনারের পদে কাজ করেন। ডিরেক্টর জেনারেল অফ মিলিটারি ইন্টিলিজেন্স[DG MI] মে. জেনারেল ইকবাল খান চার তারকা খচিত জেনারেলে পদোন্নতি পান এবং জয়েন্ট চীফস অফ স্টাফ কমিটির[JCSC] চেয়ারম্যান হিসেবে পদোন্নতি পান। মে. জেনারেল গোলাম ওমর[সেক্রেটারি অফ ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল] অবসরের পর ন্যাশনাল ল্যাংগুয়েজ অথরিটিতে কাজ করেন। ডিরেক্টর জেনারেল মিলিটারি অপারেশন্স[DGMO] মে. জেনারেল মজিদ মালেক লে. জেনারেল পদে পদোন্নতি লাভ করেন। অবসরের পরে তিনি মরক্কোয় রাষ্ট্রদূত পদে কাজ করেন এবং পরে মিনিস্টার অফ কাশ্মীর এফেয়ার্স হন। লে. জেনারেল নিয়াজি বলেছিলেন যে তিনি দূর্নীতির জন্য ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাবকে পশ্চিম পাকিস্তানে ফেরত পাঠান।[৬৮]

আরবাব লে. জেনারেল পদে পদোন্নতি পান। তিনি কর্প্স কমান্ডার এবং সিন্ধ প্রদেশের গভর্নর হন। অবসরের পর তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতে রাষ্ট্রদূতের পদে কাজ করেন। ভারত থেকে মুক্তি পাওয়ার পর নিয়াজি কিছুকাল রাজনীতি করেন এবং বিভিন্ন জনসভায় বক্তব্য দ্যান। খুলনা নৌঘাঁটির ইনচার্জ কমান্ডার গুল জারিন একটি গানবোট নিয়ে সাগরের দিকে পালিয়ে যান। পরে তাকে একটি বিদেশি জাহাজ উদ্ধার করে। আত্মসমর্পণের নয় দিন আগে ডিসেম্বরের সাত তারিখে এটি ঘটে। এই অফিসারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিলো কিনা জানা যায়নি।

১৯৭১ সালের কুকর্মের অভিযোগে অভিযুক্ত অফিসারদের জবাবদিহিতা নিয়ে জেনারেল মুশাররফের মন্তব্যটি সঠিক নয়। তিনি বলেন, “এটি আমাদের ইতিহাসের একটি বিয়োগান্তক অংশ তবে জাতির উচিত অতীতের মাঝে বসবাস না করে সামনের দিকে এগিয়ে চলা। আমাদের ব্যাপারটিকে ইতিহাসের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত। একজন পাকিস্তানী হিসেবে আমি ১৯৭১ ভুলে যেতে চাই।”[৬৯]

যদি জাতি ১৯৭১ ভুলে যায় তবে সেই ভুলগুলো আবার হওয়ার সম্ভবনা অনেক বেশি। ১৯৭১ এর নায়কদের অনেকেই আজ মৃত। যারা বেঁচে আছেন তাদের নৈতিক দায়িত্ব হলো সততার সাথে তাদের দায়দায়িত্ব স্বীকার করা। প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের দায়িত্ব হিসেবে একজন সেনানীর এই কাজটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভুল স্বীকার করা মহত্ত্বের লক্ষণ, দূর্বলতার নয়। চুলচেরা বৈধতার দৃষ্টিতে সবাই নির্দোষ যেহেতু কাউকেই আইনের মাধ্যমে আদালতে নেওয়া হয়নি এবং অভিযুক্ত করা হয়নি। এর চেয়েও অনেক বেশি মর্যাদাকে সমুন্নত রাখতে হবে। একজন সেনানীর নীতিমালা এবং নৈতিক বিধি এটাকেই প্রয়োজনীয় করে যে, যারা এখনো বেঁচে আছেন তাদের ‘সম্মানের’ বিকৃত বোধ রক্ষা করার প্রচেষ্টার চেয়ে সত্যপ্রকাশ করে সামনে এগিয়ে আসা উচিত।

শেষকথা
পাকিস্তানের মত বহুজাতিক রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ সেনাবাহিনী নিলে খুবই জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। বিশেষ করে যেখানে সবগুলো জাতিগোষ্ঠির অবস্থান সামরিক বাহিনীতে নেই। সামরিক বাহিনীর ক্ষমতার ‘জবরদখল জাতিগোষ্ঠিক রাজনীতির ওপর প্রভাব ফেলে। পূর্বের জাতিগোষ্ঠিগতভাবে প্রধান অংশে কিংবা/এবং জাতিগতভাবে বিদ্যমান চেতনাকে তীব্রতর করে তোলে।’[৭০] রাষ্ট্র এবং ক্ষুদ্ধ জাতিগোষ্ঠির মাঝের ভয়াল মহড়ার এটাই হলো ভূমিকা। দেশ এটি দেখেছে বাঙালি, বালুচ, সিন্ধ ও মুহাজিরদের সাথে। ‘সরাসরি ভারতীয় মধ্যস্ততায় বাঙালি জাতীয়তাবাদের সফলতা হলো আভ্যন্তরীণ শোষণ, আঞ্চলিক হস্তক্ষেপ ও অনাঞ্চলিক প্রতিযোগিতার সবচেয়ে চরম উদাহরণ।’[৭১]

পাকিস্তানের সামাজিক সমস্যা বহুধাবিভক্ত। এর সমাধানের জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ও কাজের প্রয়োজন। অতীত যদি কোনো নির্দেশনার আলো হয় তবে তা আমাদের ব্যাপকভাবে শিক্ষা দ্যায় যে বর্তমান সংকটের সমাধান হলো সরকারের প্রতিনিধিত্বমূলক ভূমিকা, যেখানে জোটরাষ্ট্রের প্রতিটি সদস্য মনে করবে যে নীতি নির্ধারণী প্রক্রিয়ায় তার অংশগ্রহণ রয়েছে। সমস্যা তুলে ধরার জন্য তৃণমূল পর্যায়ের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ খুব গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠির সরকারের শুধু একজন পুতুলরাজা দিয়ে কখনোই সমস্যার সমাধান হবে না। শাসকগোষ্ঠির কাছে এ সত্যটি না নিয়ে এলে কেন্দ্রীয় অধিকারীদের পরিধির এক বা আরেক অংশের সাথে চিরস্থায়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়বে। রাষ্ট্রের ভারসাম্য হবে দোদুল্যমান। এটা মনে রাখা উচিত যে, ‘দাবিয়ে রাখা অভিজাতদের নিজস্ব লক্ষ্য এবং মনোভাবই বিচ্ছিন্নতা আনার হুমকি দ্যায়।’[৭২]

হামুদ-উর-রহমান কমিশনের রিপোর্ট ত্রিশ বছর আগে প্রকাশিত হলে জাতি এই অনুচ্ছেদ শেষ করে দিতে পারতো। ত্রিশ বছর পরে পুরনো ক্ষত খুলে ধরার মর্মান্তিক কারণ হলো, জাতি এবং তার নেতাদের সত্যের মুখোমুখি হওয়াতে অস্বীকার করা। জাতি হিসেবে পাকিস্তানের প্রথম পদক্ষেপ হলো এর ভুলগুলো স্বীকার করা এবং ১৯৭১ এর কার্যক্রমের কারণে বাঙালিদের কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থনা করা। নতুন শুরুর জন্য গোপন সব ভয়াবহতাকে বের করে দেওয়া উচিত। সকল পুরনো দানবদের আঁধার থেকে আলোতে এনে দূরিভূত না করা হলে তারা জাতিকে তাড়িয়ে বেড়াবে চিরকাল।

হাসির নয়, নয় কান্নার, শুধুই বোঝার।- স্পিনোজা

তথ্যসূত্র-
[১] Amin, A. H. The Western Theatre in 1971 — A Strategic and Operational Analysis. Defence Journal (Karachi. Online Edition. All further references are from online edition), February 2002
[২] Binder, Leonard. Islam, Ethnicity, and the State in Pakistan in Banuazizi, Ali and Weiner, Myron (Ed.) The State, Religion and Ethnic Politics: Pakistan, Iran and Afghanistan (Lahore: Vanguard Books, 1987), p. 265
[৩] Hussain, Asaf. Ethnicity, Identity and Praetorianism in Pakistan. Asian Survey, Vol. XVI; No: 10, October 1976, p. 925
[৪] Ali, Mahmud. The Fearful State (London: Zed Books, 1993), p. 252
[৫] Ibid, p. 249
[৬] Von Vorys, Karl. Political Development in Pakistan, (Princeton, New Jersey: Princeton University Press, 1965)p. 155
[৭] Murshid, M. Tazeen. A House Divided: The Muslim Intelligentsia of Bengal in Low A. Donald (Ed.) The Political Inheritance of Pakistan (London: MacMillan, 1991), p. 147
[৮] Metcalf, Barbara D. & Metcalf, Thomas R. A Concise History of India, p. 111
[৯] Rahman, Hafizur. Why was Bengal Ignored? The News (Lahore. Internet Edition), February 17, 2001
[১০] Murshid, Tazeen. A House Divided, p. 159
[১১] Talbot, Ian. Pakistan: A Short History (New York: St. Martin’s Press, 1998), p. 24-25
[১২] McGrath, Allen. The Destruction of Democracy in Pakistan (Karachi: Oxford University Press, 1996), p. 4-5
[১৩] Baxter, Craig. Bangladesh: From Nation to a State (Boulder, Colorado: Westview Press, 1997), p. 72
[১৪] Murshid, Tazeen. A House Divided, p. 159
[১৫] Talbot, Ian. Pakistan, p. 163
[১৬] Zaheer, Hassan. The Separation of East Pakistan (Karachi: Oxford University Press, 1994), p. 24
[১৭] Murshid, Tazeen. A House Divided, p. 165
[১৮] Zaheer. The Separation, p. 26
[১৯] Jafferlot, Christopher. Nationalism Without a Nation: Pakistan Searching for its Identity (London: Zed Books, 2002), p. 18
[২০] Zaheer. The Separation, p. 38
[২১] Von Vorys, Karl. Political Development in Pakistan, p. 218
[২২] Gauhar, Altaf. Ayub Khan: Pakistan’s First Military Ruler (Karachi: Oxford University Press, 1996), p. 100-101
[২৩] Budget Speech of Finance Minister in Constituent Assembly (Legislature) of Pakistan Debates (CALD), Vol. 1; No:2 (15 March 1952), p. 44 cited in Hasan, Zaheer. The Separation, p. 51
[২৪] Gauhar, Altaf. Ayub Khan, p. 98-99
[২৫] Lodhi, Sardar F. S. Lt. General (r). Security Concerns of Pakistan. Defence Journal, December 1998
[২৬] Salasal, Jalees. Court Martial, p. 232
[২৭] Siddique, A. Pak-Bangladesh Relations. The Nation (Lahore: Online Edition. All further references from online edition)), August 03, 2002
[২৮] Prime Minister’s meeting with US Charge, Emmerson on May 29, 1954 in Karachi. Foreign Relations of the United States (FRUS). 1952-1954 Volume XI. Department of State Publication 9281 (Washington: U.S. Government Printing Office, 1983), p. 1864, hereafter referred as FRUS
[২৯] The ambassador in Pakistan (Hildreth) to Department of State on subject of conversation with General Ayub Khan on July 15, 1954 (Secret). FRUS, p. 1856
[৩০] Maniruzzaman, Talukdar. Group Interests and Political Change: Studies of Pakistan and Bangladesh (New Delhi: South Asian Publishers, 1982), p. 86
[৩১] The Nation, July 30, 2002
[৩২] Lt. General Sahibzada Yaqub Khan’s conversation with Hasan Zaheer in Zaheer, Hasan. The Separation, p. 141
[৩৩] Niazi, Amir Abdullah Khan. Lt. General (r). The Betrayal of East Pakistan (Karachi: Oxford University Press, 1999), p. 34
[৩৪] Interview of Major General Rao Farman Ali who was present in that meeting cited in Hassan, Ali. Pakistan: Generals aur Siyasat, Urdu (Pakistan: Generals and Politics) (Lahore: Vanguard Books, 1991), p. 167
[৩৫] Major General M. I. Karim’s account of the meeting in Zaheer, Hasan. The Separation, p. 346
[৩৬] Salik, Siddique. Witness to Surrender (Karachi: Oxford University Press, 1977), p. 107
[৩৭] Akhund, Iqbal. Memoirs of a Bystander (Karachi: Oxford University Press, ), p. 211
[৩৮] Siddiqi, A. R. Brigadier (r). Military in Pakistan: Image and Reality (Lahore: Vanguard Books, 1996), p. 195
[৩৯] Zaheer. The Separation, p. 310-311
[৪০] Akbar, Ahmad S. Pakistan, Jinnah and Islamic Identity: The Search for Saladin (London: Routledge, 1997), p. 238
[৪১] Mascarenhas, Anthony. The Rape of Bangladesh (Delhi: Vikas Publications, 1971), p. 117
[৪২] Loshak, David. Pakistan Crisis (New York: McGraw Hills Book Company, 1971), p. 112
[৪৩] Ibid, p. 108
[৪৪] Salik. Witness, p. 78
[৪৫] For details of eyewitness accounts of killing of Bengali university professors, see Malik, Amita. The Year of Vulture (New Delhi: Orient Longman Ltd., 1972), p. 75-77 and Kabir, Mafizullah. Experience of an Exile at Home: Life in Occupied Bangladesh (Dacca: Asiatic Press, 1972), p. 35, 40 & 41
[৪৬] Confidential instructions sent from HQ Eastern Command to formations dated April 15, 1971, provided by Niazi to his interviewer cited in Salasal, Jalees. Court Martial, p. 187
[৪৭] Ali, F. B. Brigadier (r). Good, Decent Men, But… The Frontier Post (Peshawar. Online Edition), August 25, 2000
[৪৮] Niazi. The Betrayal, p. 46 & Herald (Karachi), September 2000, p. 29
[৪৯] Masood, Talat. Lt. General (r). Pitfalls of the Military’s Over-Stretch. Dawn (Karachi. Online Edition), August 20, 2001
[৫০] ‘The Military Implications of Pakistan’, memorandum by Claude Achinleck attached to a letter from Achinleck to Mountbatten, 24 April 1947, Jonh Ryland’s University Library of Manchester, Achinleck MSS, File 76, No:1224b, 2 cited in Wainwright, Martin A. Inheritance of Empire: Britain, India, and the balance of power in Asia, 1938-55 (Westport, Connecticut: Praeger, 1994), p. 74
[৫১] Hamid, Shahid. Major General (r). Disastrous Twilight, Appendix IX, p. 335
[৫২] Arif, Khalid M. General (r). Khaki Shadows: Pakistan 1947-1997 (Karachi: Oxford University Press, 2001), p. 125
[৫৩] Jahan, Rounaq. Pakistan: Failure in National Integration (New York & London: Columbia University Press, 1972), p. 166-67
[৫৪] Amin. The Western Theatre
[৫৫] FRUS. Publication 1996, p. 649-50
[৫৬] Malik, Iftikhar H. State and Civil Society in Pakistan: Politics of Authority, Ideology and Ethnicity (Lahore: M. Anwar Iqbal for MacMillan Publishers, 1997) p. 79
[৫৭] Enloe, Cynthia. Ethnic Soldiers: State Security in Divided Societies (Athens, Georgia: University of Georgia Press, 1980), p. 52
[৫৮] Malik, Tajjamal Hussain. Major General (r). The Story of My Struggle (Lahore: Jang Publishers, 1992, Second Edition), p. 29
[৫৯] Author’s interview with a former Bengali officer of Pakistan army, October 2002
[৬০] Zaheer. The Separation, p. 169-70
[৬১] Heitzman, James & Worden, Robert L. (Ed.) Bangladesh: A Country Study. Federal Research Division, Library of Congress. (Washington, D.C: Government Printing Office, 1989), p. 209-211)
[৬২] Author’s interview with a former Bengali officer of Pakistan army, October 2002
[৬৩] Niazi. Betrayal of East Pakistan, p. 66
[৬৪] Akbar, Ahmad. Pakistan, Jinnah, p. 239
[৬৫] Interview with Air Marshal Jamal Ahmad Khan in Salasal, Jalees. Court Martial (Urdu) (Karachi: Al-Jalees Overseas Publishing Svc., 1999), p. 218
[৬৬] Indian jets had attacked oil refinery in Karachi and sent sorties to different cities. On Sindh border, Indian pilots had a field day of target practice, where half of a tank regiment (22 tanks) was knocked out of action.
[৬৭] Zaheer. The Separation, p. 424
[৬৮] Herald, September 2000, p. 29
[৬৯] The Nation, September 12, 2000
[৭০] Enloe, Cynthia. Ethnic Soldiers, p. 129
[৭১] Ali, Mahmud. The Fearful State, p. 14
[৭২] Ibid, p. 252
 
Source rajnitibd.blogspot.co

Sunday, August 21, 2011

 ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সাত বছর :তাজউদ্দিনকে পাকিস্তানে পাঠায় ডিজিএফআই, জানতেন খালেদা

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী ও গ্রেনেড সরবরাহকারী মাওলানা তাজউদ্দিনকে পাকিস্তানে পাঠিয়েছিল প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) জঙ্গি দমন-সংক্রান্ত ব্যুরো। আর এটা জানতেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াও। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার সম্পূরক অভিযোগপত্রে এই তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।
এ ছাড়া ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় হরকাতুল জিহাদের (হুজি) জঙ্গিদের সঙ্গে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও শিক্ষা উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু জড়িত ছিলেন—এমন তথ্য ২০০৬ সালের আগস্টেই (বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে) বেরিয়ে আসে। তখন এই তথ্য এবং তাজউদ্দিনকে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ সম্পর্কে ডিজিএফআইয়ের তৎকালীন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল সাদিক হাসান রুমী প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে জানিয়েছিলেন। সাদিক হাসান রুমী গত বছরের ২০ জুন আদালতে সাক্ষী হিসেবে দেওয়া জবানবন্দিতে এই ব্যাপারে বিস্তারিত বলেছেন।
২১ আগস্ট মামলার সম্পূরক অভিযোগপত্র, ডিজিএফআইয়ের সাবেক চার কর্মকর্তা ও হুজির শীর্ষনেতাদের আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে দেখা যায়, ডিজিএফআইয়ের জঙ্গিবাদ দমন-সংক্রান্ত গোয়েন্দা শাখা (কাউন্টার টেররিজম ইন্টিলিজেন্ট ব্যুরো—সিটিআইবি) চারদলীয় জোট সরকারের আমলে জঙ্গিদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করত। ডিজিএফআই থেকে নিয়মিত টাকাও পেতেন হুজির শীর্ষনেতারা।
অবশ্য ডিজিএফআইয়ের তৎকালীন তিন কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল আফজাল নাছের ভূঁইয়া (পরে বহিষ্কৃত), মেজর সৈয়দ মনিরুল ইসলাম (পরে বহিষ্কৃত) ও লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মিজানুর রহমান আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেছেন, হুজির নেতা মাওলানা আবদুস সালাম, মাওলানা শেখ ফরিদ, মাওলানা রাজ্জাক, মাওলানা সাব্বির ও মাওলানা মনির সিটিআইবিতে তথ্য সরবরাহকারী হিসেবে (সোর্স) কাজ করতেন। এ জন্য তাঁদের নিয়মিত টাকা দেওয়া হতো। এ ছাড়া হুজির সাবেক আমির মুফতি শফিকুর রহমান, হাফেজ ইয়াহিয়া, আবু বকর ও কাশ্মীরের জঙ্গি সংগঠন হিজবুল মুজাহিদীনের নেতা আবু ইউসুফ ওরফে মাজেদ বাটও বিভিন্ন সময় ডিজিএফআইয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন বলে তাঁরা স্বীকার করেছেন। এসব জঙ্গিও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার অভিযুক্ত আসামি।
হুজির সাবেক আমির মাওলানা আবদুস সালামও আদালতে জবানবন্দিতে বলেছেন, ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সারা দেশে একযোগে বোমা হামলার পর থেকে তাঁর সঙ্গে ডিজিএফআইয়ের যোগাযোগ গড়ে ওঠে। সালাম দাবি করেন, তাঁরাই ডিজিএফআইকে তথ্য দিয়ে মুফতি হান্নান ও সিলেটে ব্রিটিশ হাইকমিশনারের ওপর গ্রেনেড হামলায় জড়িত হুজির জঙ্গি শরিফ শাহেদুল ওরফে বিপুলকে ধরিয়ে দিয়েছেন।
লে. কর্নেল আফজাল, মেজর মনিরুল ও লে. কমান্ডার মিজানের জবানবন্দিতেও একই তথ্য রয়েছে।
লে. কমান্ডার মিজান আদালতকে বলেন, সিলেটের বিপুলকে ধরিয়ে দিতে মাওলানা সালাম পাঁচ লাখ টাকা দাবি করেছিলেন। এ কাজে পরে সালামকে তিন লাখ টাকা দেওয়া হয়েছিল। সেখান থেকে মাওলানা রাজ্জাক পেয়েছেন এক লাখ টাকা। মিজানের দায়িত্ব ছিল লে. কর্নেল সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দারের নির্দেশে হুজির নেতাদের কাছে টাকা পৌঁছে দেওয়া।
অধিকতর তদন্ত: বর্তমান সরকারের আমলে অধিকতর তদন্ত শেষে সিআইডি গত ৩ জুলাই ২১ আগস্টের দুই মামলার সম্পূরক অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেয়। এতে খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, বিএনপির সাংসদ শাহ মোফাজ্জল হোসাইন কায়কোবাদ, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, ডিজিএফআইয়ের সাবেক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, মেজর জেনারেল (অব.) এ টি এম আমিন, লে. কর্নেল (বরখাস্ত) সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) সাবেক মহাপরিচালক আবদুর রহিম, খালেদা জিয়ার ভাগনে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ডিউকসহ ৩০ জনকে নতুন করে আসামি করা হয়েছে।
যেভাবে তাজউদ্দিনের নাম আসে: অভিযোগপত্রে উল্লেখ আছে, তাজউদ্দিন পাকিস্তানের মাদ্রাসায় পড়াশোনা করার সময় কাশ্মীরভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তাইয়েবা, তেহরিক-ই জিহাদ আল ইসলাম ও হিজবুল মুজাহিদীনের সঙ্গে জড়িত হন।
মেজর জেনারেল সাদিক হাসান রুমী, লে. কর্নেল আফজাল, মেজর মনির ও লে. কমান্ডার মিজানের জবানবন্দিতে তাজউদ্দিনকে বিদেশে পাঠানোর বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। এই চারজন এখন ২১ আগস্ট মামলার অন্যতম সাক্ষী। তাঁদের জবানবন্দি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সিলেটে বাংলাদেশে তখনকার ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলার ঘটনা নিয়ে চাপে পড়ে বিএনপি সরকার। ২০০৬ সালের আগস্টে গ্রেনেড নিক্ষেপকারী বিপুল ও তাঁর সহযোগী মিজানকে সিলেট থেকে আটক করে গোয়েন্দারা। যৌথ জিজ্ঞাসাবাদ কেন্দ্র টাস্কফোর্স ফর ইন্টারোগেশনে (টিএফআই) হাইকমিশনারসহ সিলেটে বিভিন্ন গ্রেনেড হামলার কথা স্বীকার করেন বিপুল। তিনি জানান, মুফতি হান্নান তাঁদের আর্জেস গ্রেনেড সরবরাহ করেছিলেন। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাও মুফতি হান্নান পরিচালনা করেছেন।
এই তথ্যের ভিত্তিতে তখন রিমান্ডে থাকা মুফতি হান্নানকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তিনি ২১ আগস্ট হামলায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন এবং বিস্তারিত বিবরণ দেন। মুফতি হান্নান তখন আরও জানান, তাঁকে গ্রেনেড সরবরাহ করেছেন উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন।
এভাবে মাওলানা তাজউদ্দিনের নাম বেরিয়ে আসে। ডিজিএফআইয়ের সাবেক কর্মকর্তারা জবানবন্দিতে বলেছেন, এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের একটি গোয়েন্দা সূত্র থেকে তাজউদ্দিনের ব্যাপারে তথ্য পান। তা ছিল: তাজউদ্দিন লস্কর-ই-তাইয়েবার জন্য বাংলাদেশ হয়ে ভারতের কাশ্মীরে অস্ত্র-গোলাবারুদ পাঠানোর কাজে যুক্ত।
ডেকে এনে পাকিস্তানে পাঠানো: মুফতি হান্নানের স্বীকারোক্তির পর হুজির মাওলানা সালামের সহায়তায় ২০০৬ সালের অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহের কোনো একদিন তাজউদ্দিনকে ডেকে আনা হয় গুলশানে ডিজিএফআইয়ের একটি ‘সেফ হাউসে’। পরে লে. কর্নেল সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার, লে. কর্নেল আফজাল ও মেজর মনির সেখানে আসেন। তাঁরা একসঙ্গে রাতের খাবার খান। সাইফুল ও আফজাল এরপর তাজউদ্দিন ও সালামের সঙ্গে একান্ত আলোচনা করেন। একপর্যায়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (পরে মেজর জেনারেল) এ টি এম আমিন যোগ দেন তাঁদের সঙ্গে। সালাম ও মিজানদের অন্য কক্ষে পাঠিয়ে আমিন, সাইফুল ও আফজাল দীর্ঘ সময় তাজউদ্দিনের সঙ্গে আলাপ করেন।
ওই দিন থেকে পাকিস্তানে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তাজউদ্দিন ডিজিএফআইয়ের গুলশানের ওই ‘অতিথিশালা’তেই ছিলেন।
পরদিন বেলা ১২টায় আবার আমিন, সাইফুল ও আফজাল কয়েক ঘণ্টা তাজউদ্দিনের সঙ্গে কথা বলেন। তখন তাজউদ্দিন গ্রেনেড সরবরাহ করা থেকে শুরু করে তাঁর ভাই উপমন্ত্রী পিন্টুর বাসায় বৈঠক, হামলাকারীদের নিরাপত্তার জন্য স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের সর্বাত্মক সহায়তাসহ ২১ আগস্ট হামলার সার্বিক বিবরণ দেন।
ডিজিএফআইয়ের কর্মকর্তা আফজাল, মনির ও মিজান জবানবন্দিতে বলেছেন, তাজউদ্দিনের এসব তথ্য তখন আমিন ও সাইফুল মুঠোফোনে ঊর্ধ্বতন কাউকে জানান। তারপর তাঁদের বলেন, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবর এই বিষয়ে কোনো বাড়াবাড়ি না করে তাজউদ্দিনকে দ্রুত পাকিস্তান পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন। আর তাজউদ্দিনের পাসপোর্ট, টিকিট ও ভিসা জোগাড়ের দায়িত্ব দেওয়া হয় মেজর মনির ও লে. কমান্ডার মিজানকে। মাত্র দুই দিনের মধ্যে লে. কর্নেল সাইফুল পাসপোর্ট, পাকিস্তান যাওয়ার ভিসা ও বিমানের টিকিট এনে দেন। তাঁর নির্দেশে মিজান ও মনির মাওলানা তাজউদ্দিনকে করাচিগামী বিমানে তুলে দেন ২০০৬ সালের ১০ অক্টোবর। পাকিস্তানে যাওয়ার পরও তাজউদ্দিন টেলিফোনে কর্নেল সাইফুল ও মেজর মনিরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। তাঁকে বলা হয়েছে, ডিজিএফআইকে না জানিয়ে তিনি যেন বাংলাদেশে না আসেন।
তাজউদ্দিনকে গ্রেপ্তার না করে পাকিস্তান পাঠানোর এ তথ্য ডিজিএফআইয়ের মহাপরিচালকও জানতেন।
খালেদা কতটা জানতেন: সম্পূরক অভিযোগপত্রে বলা হয়, বাবরের নির্দেশে ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর জ্ঞাতসারে মাওলানা তাজউদ্দিনকে বিদেশে পাঠানো হয়েছে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সহকারী লে. কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ডিউক, তাঁর (ডিউক) ভায়রা ডিজিএফআইয়ের লে. কর্নেল (বরখাস্ত) সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার ও সিটিআইবির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ টি এম আমিন পরস্পর যোগসাজশে বাদল ছদ্মনামে তাজউদ্দিনের জন্য পাসপোর্ট করান। ২০০৬ সালের ১০ অক্টোবর তাজউদ্দিনকে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেন তাঁরা।
ডিজিএফআইয়ের তৎকালীন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) সাদিক হাসান রুমী আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেছেন, ‘মুফতি হান্নানের জবানবন্দিতে তৎকালীন সরকারের দুই মন্ত্রীর জড়িত থাকার কথা উল্লেখ থাকায়, আমি তা “টকিং পয়েন্ট” হিসেবে লিখিতভাবে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে দিই। এবং আমি নিজেও ঘটনাটি প্রধানমন্ত্রীকে সরাসরি বলি। তিনি কিছু না বলে টকিং পয়েন্টটি তাঁর কাছেই রেখে দেন। পরে প্রধানমন্ত্রী এই বিষয়ে আমাকে কোনো নির্দেশ দেন নাই।’
সাদিক হাসান রুমী বলেন, পরে তাঁকে এ টি এম আমিন ও সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার এসে বলেন, বাবর ও ডিউক তাঁদের জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনকে বিদেশে পাঠিয়ে দিতে বলেছেন। তাই তাজউদ্দিনকে পাকিস্তানে পাঠানোর সব ব্যবস্থা করা হয়েছে।
অধীনস্থ কর্মকর্তাদের এই তথ্য যাচাই করতে জেনারেল রুমী প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে যান। প্রধানমন্ত্রীর কাছে পুরো বিষয় তুলে ধরেন। রুমী বলেন, ‘আমার কথা শুনে প্রধানমন্ত্রী অনেকটা ক্ষুব্ধ ও বিরক্তির সুরে বলেন, “সিআইডি এই মামলার রহস্য ইতিমধ্যে উদ্ঘাটন করে ফেলেছে (জজ মিয়া কাহিনি), আপনি কোথা থেকে এই সব আজগুবি তথ্য নিয়ে এসেছেন? মাওলানা তাজউদ্দিন পাকিস্তান যাবে না কোথায় যাবে, তাতে আপনার মাথাব্যথা কেন?” এই বলে তিনি আমার সাথে আর কোনো কথা বলেন নাই।’
বিএনপির বক্তব্য: ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলার অভিযোগপত্রে এভাবে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নাম আসার বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় খালেদা জিয়া ও বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে জড়ানোর পাঁয়তারা এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই শুরু করেছিল। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান জড়িত—অনেককে চাপ দিয়ে এ কথা বলানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘মামলার তদন্ত চলাকালে বিএনপির পক্ষ থেকে একাধিকবার সংবাদ সম্মেলন করে এবং একাধিক সমাবেশে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে আসামি করার আশঙ্কার কথা বলা হয়েছিল। বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিকে রাজসাক্ষী করার প্রলোভন দেখানো হচ্ছিল বলেও তখন আমরা বলেছিলাম।’
মির্জা ফখরুল আরও বলেন, অধিকতর তদন্তের নামে মূলত খালেদা জিয়া, তারেক রহমান ও বিএনপির নেতাদের ফাঁসানোই ছিল সরকারের লক্ষ্য। যখন কোনো তথ্যপ্রমাণ তদন্তকারী পেল না, তখন সরকারের চাপে তারেককে আসামি করা হয়েছে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বলেন, বিএনপিকে ধ্বংসের এ ধরনের চেষ্টার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও আইনি লড়াই চালানো হবে।

Monday, August 15, 2011

তবু কেন রাষ্ট্রধর্ম(সাত বিশিষ্ট ব্যক্তির ভাবনা)

সালাহউদ্দীন আহমদ  কবীর চৌধুরী  সরদার ফজলুল করিম  জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী  সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী  আনিসুজ্জামান  কাইয়ুম চৌধুরী |

সালাহউদ্দীন আহমদ, কবীর চৌধুরী, সরদার ফজলুল করিম, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আন
সালাহউদ্দীন আহমদ, কবীর চৌধুরী, সরদার ফজলুল করিম, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আনিসুজ্জামান ও কাইয়ূম চৌধুরী
বাংলাদেশের এক সামরিক শাসক নিজের ক্ষমতার ভিত্তি তৈরি করতে কাছে টেনেছিলেন মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধীদের। তিনি প্রধানমন্ত্রী করেছিলেন এমন একজনকে, যিনি ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে জাতিসংঘে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কথা বলতে। তিনি সামরিক ফরমানবলে দেশের সংবিধান সংশোধন করে রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বর্জন করেছিলেন, ধর্মাশ্রিত রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন এবং সংবিধানের সূচনায় বিসমিল্লাহ্ যোগ করেছিলেন।
বাংলাদেশের আরেক সামরিক অভ্যুত্থানের নায়কের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সারা দেশে যখন তুমুল আন্দোলন চলছিল, তখন নিজের ক্ষমতা নিরাপদ করার আশায় তিনি ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করার বিধানসংবলিত এক সাংবিধানিক সংশোধনী জাতীয় সংসদকে দিয়ে পাস করিয়ে নিয়েছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে সেদিন আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ অনেক রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজ প্রতিবাদ জানিয়েছিল এবং এককভাবে ও সমষ্টিগতভাবে অন্তত তিনটি মামলা হাইকোর্টে রুজু হয়েছিল।
দেশের মানুষ কেউ কখনো সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতার উচ্ছেদ চায়নি, রাষ্ট্রধর্মের প্রবর্তনও চায়নি। ক্ষমতাসীন ব্যক্তি ও গোষ্ঠী নিজের স্বার্থে এসব উদ্যোগ নিয়েছিল এবং, বলা যায়, দেশের অধিকাংশ মানুষ তা মেনে নিয়েছিল। তবে সচেতন জনগোষ্ঠী বরাবরই এসব ব্যবস্থাকে বাংলাদেশের সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর বিরোধী এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী বলে গণ্য করে এসেছে। তারা বারবার করে ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে ফিরে যাওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে দাবি জানিয়েছে।
বাংলাদেশের সংবিধানের রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতিগুলো গৃহীত হয়েছিল পাকিস্তান-আমলে পূর্ব বাংলার মানুষের দীর্ঘকালের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। এই প্রক্রিয়ায়ই ১৯৫১ সালে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ গঠিত হয় সে-সময়ের একমাত্র অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠানরূপে; ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অব্যবহিত পরে অসাম্প্রদায়িক ছাত্র-সংগঠনরূপে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন ও অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলরূপে গণতন্ত্রী দলের প্রতিষ্ঠা ঘটে। এই প্রক্রিয়ায়ই পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের নাম থেকে এবং তারপরে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নাম থেকে মুসলিম শব্দ বর্জিত হয়। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের একুশ দফার শীর্ষদেশে নীতি হিসেবে যদিও অঙ্গীকার করা হয় যে, ‘কোরান ও সুন্নার মৌলিক নীতির খেলাফ কোন আইন প্রণয়ন করা হইবে না এবং ইসলামের সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে নাগরিকগণের জীবনধারণের ব্যবস্থা করা হইবে’, তবু এ-নীতি কোনো দফা হিসেবে ঘোষিত হয়নি এবং এতে রাষ্ট্রের ইসলামিকরণের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়নি। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম শাসনতন্ত্র (তখন তাই বলা হতো) প্রণয়নের সময়ে গণপরিষদে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রের ইসলামি প্রজাতন্ত্র নামকরণের বিরোধিতা করে। একই সময়ে পূর্ব পাকিস্তান ব্যবস্থাপক পরিষদে যুক্ত নির্বাচনপ্রথার পক্ষে প্রস্তাব গ্রহণ করে পাকিস্তানের দ্বিজাতিতত্ত্বের মূলে কুঠারাঘাত করা হয় এবং পূর্বাঞ্চলে এই ব্যবস্থা পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রের বিধানরূপে গৃহীত হয়। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি এবং দলটি বিভক্ত হলে এর উভয় অংশ, বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন এবং অধিকাংশ সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ক্রমশ ধর্মনিরপেক্ষ মনোভাবের প্রসার ঘটাতে সাহায্য করে। অপরপক্ষও নিষ্ক্রিয় ছিল না। তারই পরিপ্রেক্ষিতে, ১৯৬৯ সালে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের বিরুদ্ধে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন। ১৯৭০ সালে জেনারেল ইয়াহিয়া খান যে-আইনগত কাঠামো আদেশ জারি করেন, তার ২০ ধারায় বলা হয়েছিল যে, পাকিস্তান পরিচিত হবে ইসলামি প্রজাতন্ত্র বলে, যে-ইসলামি ভাবাদর্শ পাকিস্তানের ভিত্তি তা রক্ষা করা হবে এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান হবেন একজন মুসলমান। ১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বরে আরো দুটি ধারার সঙ্গে ছাত্রলীগ এই ধারা সম্পর্কে আপত্তি জানায় এবং আদেশটি বাতিলের দাবি করে। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ছাত্র ইউনিয়ন প্রস্তাব করে যে, ‘রাষ্ট্র হইবে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’।
বাংলাদেশ যে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হবে, মুক্তিযুদ্ধের কালে আমাদের নেতারা সেকথা অনেকবার বলেছিলেন। শুধু প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ নন, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ এম কামরুজ্জামান, এমনকি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদও একাধিক বক্তৃতায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় তিন নীতির—গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার—ঘোষণা দিয়েছিলেন। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিরূপে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে রেসকোর্সের জনসভায় বঙ্গবন্ধু সুস্পষ্টভাবে জানিয়েছিলেন যে, ‘বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র “বাংলাদেশ” রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।’ পরে তিনি এর সঙ্গে আরো একটি নীতি যোগ করেন—জাতীয়তাবাদ। ১৯৭২ সালে এই চার নীতিই বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্র-পরিচালনার মূলনীতিরূপে গৃহীত হয়।
সুতরাং এ-কথা জোর দিয়ে বলা চলে যে, রাষ্ট্র-পরিচালনার এইসব মূলনীতি হঠাৎ করে কারো ইচ্ছায় প্রণীত হয়নি, কারো স্বার্থরক্ষার জন্যেও নির্ণীত হয়নি। এ হলো জনগণের দীর্ঘকালের সংগ্রামের ফল, নেতাদের সুচিন্তিত পথনির্দেশনার পরিণাম। অন্য কোনো রাষ্ট্রের প্রভাবে বা অনুকরণে নয়, অন্য কোনো রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতা বা কৃতজ্ঞতাস্বরূপও নয়, এ ছিল একান্তই আমাদেরই চয়িত আদর্শ। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ১৯৪৯ সালে যখন ভারতের সংবিধান প্রণীত হয়, তখন রাষ্ট্রপরিচালনার নির্দেশক নীতিগুলোর মধ্যে সমাজতন্ত্র বা ধর্মনিরপেক্ষতার স্থান ছিল না। সংবিধানের প্রস্তাবনায় সে-দেশের রূপ নির্ণীত হয়েছিল সার্বভৌম গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র (Sovereign democratic republic) বলে। পরে ১৯৭৭ সালে গৃহীত দ্বিচত্বারিংশ সংশোধনীর দ্বারা তা সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র (Soverign socialist secular democratic republic) করা হয়। ততদিনে আমাদের রাষ্ট্রনায়কেরা সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়েছেন।
রাষ্ট্রধর্মের প্রবর্তন বাংলাদেশের সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে আঘাত করেছে। রাষ্ট্রধর্মের প্রবর্তন বাংলাদেশের মানুষকে মুসলমান (রাষ্ট্রধর্মের অনুসারী) এবং অমুসলমানে (শান্তিতে পালনযোগ্য অন্যান্য ধর্মের অনুসারী) বিভক্ত করেছে। রাষ্ট্রধর্মের প্রবর্তন বাংলাদেশের অমুসলমান নাগরিকদের মধ্যেও এক ধরনের স্বাতন্ত্র্যবাদের সূচনা করেছে। রাষ্ট্রধর্ম-প্রবর্তনের পরে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্যপরিষদের প্রতিষ্ঠা তারই দৃষ্টান্ত। ১৯৯০, ১৯৯২ ও ২০০১ সালের সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের ঘটনা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মনে অনাস্থার সৃষ্টি করেছে। তার ফলে একদিকে ঘটেছে নীরব দেশত্যাগ, অন্যদিকে দেখা দিয়েছে তাদের স্বার্থরক্ষার জন্য স্বতন্ত্র নির্বাচনপ্রথার পুনঃপ্রবর্তন কিংবা সংরক্ষিত সংসদীয় আসনের চিন্তা।
বিশেষ ধর্মের প্রতি রাষ্ট্রের পক্ষপাতের ফলে যে নাগরিকদের মধ্যে বিভেদ ও বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়, একথা অনেকে মানতে চান না। তাঁরা যুক্তরাজ্যের দৃষ্টান্ত দেন। স্বাধীন ও সার্বভৌম জাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভবের পরে ইউরোপে ক্রমে ধর্ম ও রাষ্ট্রের—স্টেট ও চার্চের—পৃথকীকরণ ঘটে এবং সকল নাগরিকের ইহলৌকিক কল্যাণসাধন রাষ্ট্রের দায়িত্ব বলে স্বীকৃত হয়। তা সত্ত্বেও ইউরোপের সব দেশে রাষ্ট্র ও ধর্ম পৃথক হয়নি। যুক্তরাজ্যের রাজা ও রানী চার্চ অফ ইংল্যান্ডের রক্ষাকর্তা—এই অর্থে অ্যাংলিকান চার্চের ধর্মই যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রীয় ধর্ম। স্ক্যান্ডিনেভিয়ার একাধিক দেশ, আয়ারল্যান্ড, ইতালি ও স্পেনেও রাষ্ট্র বিশেষ বিশেষ ধর্মের আনুকূল্য করে থাকে—তবে পৃষ্ঠপোষকতা বলতে আমরা যেমন বুঝি, তেমন নয়। সেসব দেশে আমাদের দেশের মতো ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা পীড়িত হয় না। অন্যদিকে ক্যাথলিক ধর্মের অসাধারণ প্রাধান্য সত্ত্বেও ফ্রান্স ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, প্রোটেস্টান্টদের গরিষ্ঠতা সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। ইসলামি রাষ্ট্রসংস্থার (ওআইসি) অর্ধেক সদস্য-রাষ্ট্রেরই রাষ্ট্রধর্ম বলে কিছু নেই। ইন্দোনেশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত কিংবা সিরিয়ার মতো দেশ রাষ্ট্রধর্ম স্বীকার করে না। তুরস্ক কেবল ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র নয়, তার সংবিধানের যে-তিনটি বিধান কোনোমতে সংশোধনযোগ্য নয়, ধর্মনিরপেক্ষতা তার একটি; সেদেশে সম্পত্তির উত্তরাধিকার এবং নারীর স্বাধীনতা বিষয়ে ধর্মনিরপেক্ষ আইন প্রচলিত। সুতরাং কেবল উদাহরণ দিয়ে লাভ নেই, স্বদেশের অভিজ্ঞতা ও পরিস্থিতির বিবেচনায় এ-বিষয়ে করণীয় নির্ণয় করা আবশ্যক। ফরাসি বিপ্লবের আদর্শ ফ্রান্সকে ধর্মনিরপেক্ষ থাকার প্রেরণা দিয়েছে; আদি বসতিস্থাপনারীদের ধর্মীয় নিপীড়নভোগের অভিজ্ঞতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিশেষ কোনো ধর্মের সঙ্গে যুক্ত থাকতে দেয়নি। পাকিস্তান আমলে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির যে-কুফল আমরা দেখেছি, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ধর্মের নামে যে-নিপীড়ন এখানে চলেছে এবং বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠায় সকল সম্প্রদায়ের মানুষের মিলিত সংগ্রামের যে-ইতিহাস আমরা রচনা করেছি, তার পরিপ্রেক্ষিতে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শগ্রহণই আমাদের পক্ষে স্বাভাবিক ও সংগত ছিল। আমরা ঠিক তাই করেছিলাম।
পঞ্চদশ সংশোধনীর বলে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার মূলনীতি ফিরে আসছে। কিন্তু বিসমিল্লাহ্ ও রাষ্ট্রধর্ম রয়ে যাচ্ছে। ১৯৭২ সালের সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদে স্পষ্টই বলা হয়েছিল যে, ‘ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাস্তবায়নের জন্য (ক) সর্ব প্রকার সাম্প্রদায়িকতা, (খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদাদান, (গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার (ঘ) কোন বিশেষ ধর্মপালনকারীর প্রতি বৈষম্য বা তাঁহার উপর নিপীড়ন বিলোপ করা হইবে।’ একইসঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ এবং রাষ্ট্রধর্মের বিধান—অর্থাৎ রাষ্ট্র কর্তৃক ইসলামকে রাজনৈতিক মর্যাদাদান—কীভাবে পাশাপাশি থাকতে পারে, তা আমাদের স্বল্পবুদ্ধিতে বোধগম্য নয়।
বাংলাদেশের জন্যে রাষ্ট্রধর্ম যে আবশ্যক, তা কীভাবে নির্ণীত হয়েছে? একথা কি আমরা ভুলে গেছি যে, বাংলাদেশের যে-একমাত্র শাসক দেশবাসীকে রাষ্ট্রধর্ম উপহার দিয়েছিলেন, জনসাধারণ আন্দোলন করে তাঁকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে? আওয়ামী লীগকে ধর্মনিরপেক্ষতার সমর্থক জেনেও কি দেশের মানুষ একাধিকবার তাকে ক্ষমতায় আনেনি? তাহলে কাদের মুখ চেয়ে আমরা রাষ্ট্রধর্ম রাখতে চাইছি এবং ধর্মনির্বিশেষে সকল নাগরিককে দিয়ে বিসমিল্লাহ্ বলাতে চাইছি?
রাষ্ট্রধর্মের বিধান বাংলাদেশে ধর্মব্যবসায়ীদের উৎসাহিত করেছে। তাঁরা মুসলমান-অমুসলমানে পার্থক্য করেছেন, শিয়া ও আহমদিয়াদের অমুসলমান বলে ঘোষণা করেছেন এবং রাষ্ট্রের কাছে অনুরূপ ঘোষণা দাবি করেছেন। তাঁরা নারীপুরুষে বৈষম্যসৃষ্টির অভিপ্রায় প্রকাশ্যে জ্ঞাপন করেছেন। তাঁরা নারীপুরুষনির্বিশেষে মুরতাদ ঘোষণা করে মানুষকে পীড়ন করেছেন। তাঁরা নির্বিবাদে ফতোয়া দিয়ে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছেন। এ থেকেও আমাদের শিক্ষা নেওয়ার রয়েছে।
বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রে সকল নাগরিকের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে রাষ্ট্রধর্মের বিধান বর্জন করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রাখতে হলে রাষ্ট্রধর্মের বিধান বিলোপ করতে হবে। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তান-প্রতিষ্ঠার পরে রাজনৈতিক নেতারা আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে সৃষ্ট বাংলাদেশে আমাদের নেতারা কি সকল নাগরিককে সেই আদর্শ বজায় রাখার প্রেরণা দেবেন না?
লেখকবৃন্দ: দেশের বিশিষ্ট নাগরিক।
প্রথম আলো

Thursday, August 11, 2011

শেখ হাসিনা বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী নারী রাষ্ট্রপ্রধান


শেখ হাসিনা
শেখ হাসিনা
যুক্তরাষ্ট্রের টাইম সাময়িকী প্রকাশিত ২০১১ সালে বিশ্বের ১২ প্রভাবশালী নারী রাষ্ট্রপ্রধানদের তালিকায় স্থান পেয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি এই তালিকার সপ্তম স্থানে রয়েছেন। সবার ওপরে আছেন সদ্য দায়িত্ব নেওয়া থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ইংলাক সিনাওয়াত্রা।
গত ৫ আগস্ট টাইম সাময়িকীর অনলাইন সংস্করণে ২০১১ সালের বিশ্বের ১২ প্রভাবশালী নারী রাষ্ট্রপ্রধানদের একটি তালিকা দেওয়া হয়। তালিকায় স্থান পাওয়া প্রভাবশালী নারী রাষ্ট্রপ্রধানদের কর্মজীবনের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণও তুলে ধরে টাইম সাময়িকী।
প্রভাবশালী নারী রাষ্ট্রপ্রধানদের তালিকায় ইংলাক সিনাওয়াত্রার পরে রয়েছেন—জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল (দ্বিতীয়), আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টিনা ফার্নান্দেজ দে ক্রিশনার (তৃতীয়), ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট দিলমা রোসেফ (চতুর্থ), অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী জুলিয়া গিলার্ড (পঞ্চম), লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট অ্যালেন জনসন স্যারলিফ (ষষ্ঠ), বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (সপ্তম), আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জোহানা সিগার্ডারডট্টির (অষ্টম), কোস্টারিকার প্রেসিডেন্ট লুরা সিনচিলা (নবম), ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট তারজা হ্যালোনেন (দশম), লিথুনিয়ার প্রেসিডেন্ট দালিয়া গ্রেইবুস্কাইতে (১১তম) এবং ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর প্রধানমন্ত্রী কামলা পার্সাড-বিসেসার (১২তম)।
টাইম সাময়িকীতে প্রকাশিত প্রভাবশালী নারী রাষ্ট্রপ্রধানদের ব্যক্তিগত জীবনীর বিবরণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কে বলা হয়েছে, হামলা থেকে বেঁচে যাওয়ার ইতিহাস রয়েছে তাঁর। সেখানে বলা হয়, ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে সামরিক অভ্যুত্থানে তাঁর পরিবারের ১৭ জন সদস্য নিহত হন। কিন্তু বিদেশে অবস্থান করায় তখন তিনি বেঁচে যান। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তাঁর একটি জনসভায় গ্রেনেড হামলায় ২০ জনের বেশি নিহত হলেও তিনি প্রাণে বেঁচে যান।
টাইমের বিবরণে আরও বলা হয়, ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তবে ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি পরাজিত হন। কিন্তু এখানেই তাঁর পথ চলা শেষ নয়। ২০০৯ সালে নির্বাচনে তাঁর দল আওয়ামী লীগ
প্রথম আলো

Monday, August 8, 2011

বাড়ির অধিকার ছাড়লেন শেখ রেহানা


ঢাকা, অগাস্ট ০৮ (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)- বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ রেহানা ১০ বছর আগে বরাদ্দ পাওয়া সরকারি বাড়ির অধিকার ফিরে পাওয়ার আইনী লড়াইয়ে ইতি টেনেছেন।

সোমবার বিচারপতি মো. বজলুর রহমান ও বিচারপতি এম এনায়েতুর রহিমের বেঞ্চে আবেদন করে এ বিষয়ক রিট প্রত্যাহার করেছেন শেখ রেহানা।

মামলার বিষয়বস্তুর কারণে নয়, বরং উৎসর্গ করার মানসিকতা থেকে রেহানা এ রিট আর চালাতে চান না বলে প্রত্যাহার আবেদনে বলা হয়েছে।

আদালত শেখ রেহানার এই মানসিকতাকে উৎসাহিত করে।

সোমবার আদালতে শেখ রেহানার আইনজীবী হিসাবে ছিলেন ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস এবং সরকার পক্ষে ছিলেন ওই আদালতের সরকারি আইন কর্মকর্তা আশেক মোমেন।

২০০১ সালের জুলাই মাসে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ধানমণ্ডির ৬ নম্বর রোডের ২১ নম্বর বাড়িটি শেখ রেহানার নামে বরাদ্দ করে। রেহানা তা নগদ মূল্যে কিনে নেন। ২০০৫ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার বাড়িটি সরকারি মালিকানায় নিয়ে সেখানে ধানমণ্ডি থানা স্থাপন করে।

সরকারের এ সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে শেখ রেহানা ২০০৬ সালের ২৪ জানুয়ারি উচ্চ আদালতে একটি রিট পিটিশন করলে আদালত সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চায়।

বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার স্বামী সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান আততায়ীর গুলিতে নিহত হওয়ার পর খালেদাকে তৎকালীন সরকার এরকম সুবিধা দিয়েছিলো।

গুলশানে একশ এক টাকায় দেড় একর আয়তনের একটি বাড়ি 'কেনেন' তিনি।

সেনানিবাসে শহীদ মঈনুল সড়বে এক টাকায় ১৯৮১ সালের ৮ জুলাই আট বিঘা আয়তনের একটি বাড়িও ইজারা দেওয়া হয় খালেদাকে।

গত বছরের ১৩ জুলাই খালেদাকে ওই বাড়ি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।

'জনগণের কল্যাণে অধিকার ত্যাগ'

রিট প্রত্যাহার আবেদনে বলা হয়, শেখ রেহানা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট মেয়ে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মত্যাগ ও অবদানের কারণে মেয়ে হিসাবে তিনি গর্বিত।

'বঙ্গবন্ধুর বড় মেয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িসহ পিতার রেখে যাওয়া সব সম্পত্তি দেশের জনগণের সেবায় দান করেছেন। টুঙ্গিপাড়ার বাড়িটিও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্টের নামে দিয়ে দেওয়া হয়েছে।'

শেখ রেহানার ঢাকায় কোনো বাড়ি নেই- এ কথা উল্লেখ করে রিট আবেদনে বলা হয়, বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসাবে সরকার আইন অনুযায়ী তাকে একটি বাড়ি দিতে বাধ্য এবং ইতিপূর্বে তার বাড়ি কেড়ে নেওয়ার সিদ্ধান্তটিও ছিলো অবৈধ।"

'কিন্তু বাড়িটি বর্তমানে থানা হিসাবে জনগণের কল্যাণে ব্যবহৃত হওয়ার কারণে তিনি তার অধিকার ত্যাগ করতে চান।'

শেখ রেহানাকে বাড়িটি বরাদ্দ দেওয়া হয় জাতির পিতার পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা আইনের আওতায়। চারদলীয় জোট সরকার আইন ও বরাদ্দ বাতিল করে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর জাতির পিতার পরিবার-সদস্যদের নিরাপত্তা আইন-২০০৯ পাশ করা হয়। ওই আইনে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা এবং তাদের সন্তানদের আজীবন এসএসএফ অর্ডিন্যান্স-১৯৮৬ অনুযায়ী ভিআইপি হিসাবে সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

এছাড়া ওই আইন অনুযায়ী সরকার পরিবারের সদস্যদের প্রত্যেকের জন্য নিরাপদ ও সুরক্ষিত আবাসন ব্যবস্থা করবেন বলেও উল্লেখ রয়েছে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটক

ছাত্রলীগের রোষানলে শিক্ষকেরা


ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা গতকাল ছাত্রবিষয়ক কার্যালয় ভাঙচুর করেনগতকাল ছাত্রলীগের হামলায় গুরুতর আহত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকএর আগে শিক্ষক সমিতির মিছিল চলার সময় কটূক্তি করার অভিযোগে ছাত্রলীগের দুই কর্মীকে আটক করেন শিক্ষকএরপর শুরু হয় ছাত্রলীগের তাণ্ডব। তাদের দেওয়া আগুনে পুড়ছে মোটরসাইকেল
ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি) গতকাল সোমবার বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ধাওয়া ও হামলায় পাঁচজন শিক্ষকসহ ২০ জন আহত হয়েছেন। এ সময় ক্যাম্পাসে ব্যাপক ভাঙচুর ও দুটি মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগ করা হয়।
ছিনতাইয়ে জড়িত অভিযোগে ছাত্রলীগের দুই কর্মীকে পুলিশে সোপর্দের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের কর্মীরা শিক্ষকদের ধাওয়া ও হামলা করেন। এদিকে রোববার রাতে প্রক্টরকে গালিগালাজ ও তাঁর বাসভবনের সামনে ভাঙচুরের প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি গতকাল দুপুর থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী, পুলিশ ও ছাত্রলীগ সূত্রে জানা গেছে, ছাত্রলীগের পাঁচ নেতা-কর্মী আরিফুল ইসলাম, নূর মোহাম্মদ, সাজ্জাদ হোসেন, সুমন চন্দ্র রায় ও শাকিল গত রোববার দুপুর ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেনে যান। তাঁরা সেখানে আপত্তিকর অবস্থায় তিন জুটিকে দেখে জুটিগুলোর কাছে চাঁদা দাবি করেন। চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানানোয় তাঁরা তিনটি মুঠোফোন ছিনিয়ে নেন। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ওই পাঁচজন সেখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদীচীর ধারে নদীর পাড়ে যান। সেখানে তাঁদের তিনজন থেকে যান এবং আরিফুল ও নূর মোহাম্মদ নদীর পাড় দিয়ে হেঁটে বৈশাখী চত্বরের দিকে যান। ওই দুজনকে নিরাপত্তাকর্মীরা আটক করেন। খবর পেয়ে প্রক্টর আবু হাদী নুর আলী খান সেখানে গিয়ে ওই দুজনকে মারধর করেন এবং তাঁদের নিজ গাড়িতে করে ময়মনসিংহের কোতোয়ালি থানায় সোপর্দ করেন।
প্রশাসন সূত্র জানায়, নূর মোহাম্মদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হল ও আরিফুল ফজুলল হক হলের আবাসিক ছাত্র। প্রক্টর আবু হাদী অভিযোগ করেন, এ দুজনকে পুলিশে সোপর্দ করার জের ধরে রোববার রাত ১০টার দিকে ছাত্রলীগের একাংশ তাঁর ক্যাম্পাসের ডি/৩ বাসার সামনে গিয়ে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ, ফুলের টব ভাঙচুর করে ও গেটে লাথি মারে।
শিক্ষকদের সূত্র জানায়, রাতের ওই ঘটনার প্রতিবাদে গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির উদ্যোগে মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের গ্যালারিতে জরুরি সভা হয়। সভা শেষে বেলা একটার দিকে ওই ঘটনার প্রতিবাদে এবং এর সঙ্গে জড়িত ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের শাস্তির দাবিতে শিক্ষক সমিতির ব্যানারে মৌন মিছিল বের হয়। ক্যাম্পাসের জব্বারের মোড়ে ছাত্রলীগের একাংশের কর্মী-সমর্থকেরা মিছিলে অংশ নেওয়া শিক্ষকদের লক্ষ্য করে কটূক্তি করেন। একপর্যায়ে কয়েকজন শিক্ষক ধাওয়া করে চার শিক্ষার্থী নূরে আলম, আহসান হাবিব, রাসেল আহমেদ ও ওয়ালীউল্লাহকে ধরে ফেলেন। শিক্ষকেরা ওই চারজনকে টেনেহিঁচড়ে প্রক্টর কার্যালয়ে নিয়ে যান এবং পরে পুলিশে সোপর্দ করেন।
সূত্র জানায়, ওই চারজনকে আটক করা নিয়ে শিক্ষকদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রফিকুজ্জামান ইমন ও জ্যেষ্ঠ নেতা-কর্মীদের বাগিবতণ্ডা হয়। তাঁরা ওই চারজনকে পুলিশে সোপর্দ না করার অনুরোধ জানান। একপর্যায়ে কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের হাতাহাতি শুরু হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমানকে মারধর করা হয়। এ সময় প্রক্টর কার্যালয়, ছাত্রবিষয়ক উপদেষ্টার কার্যালয়, টিএসসি, প্রশাসন ভবন, কৃষি অনুষদ ভবনসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় ব্যাপক ভাঙচুর করা হয়। এ ছাড়া একটি ছাত্রাবাস ও শিক্ষক-কর্মকর্তাদের ব্যবহূত কয়েকটি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করা হয়। দুটি মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগও করেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। শিক্ষকেরা সেখান থেকে সরে গিয়ে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে আশ্রয় নেন। ছাত্রলীগের বিক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীরা রামদা, রড ও লাঠিসোঁটা নিয়ে শিক্ষকদের ধাওয়া করেন এবং ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। ইটের আঘাতে পোলট্রি বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সুবাস চন্দ্র দাস গুরুতর আহত হন। তিনি রাত নয়টা পর্যন্ত ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে অচেতন অবস্থায় ছিলেন।
ছাত্রলীগের ধাওয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপে মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহবুবুল প্রতীক সিদ্দিক, প্রক্টরসহ চার শিক্ষক ও কর্মকর্তা এবং ছাত্র মিলিয়ে আরও কমপক্ষে ১৫ জন আহত হন। হামলার ছবি তুলতে গেলে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার সাংবাদিকের ক্যামেরা ছিনিয়ে নেন ছাত্রলীগ কর্মীরা।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে শিক্ষক সমিতি জরুরি বৈঠক করে দোষী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত ক্লাস-পরীক্ষা না নেওয়ার তা ৎ ক্ষণিক ঘোষণা দেন। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য শিক্ষকেরা বিকেল চারটার দিকে উপাচার্যের বাসভবনে যান।
বিকেল চারটার দিকে উপাচার্য প্রক্টরিয়াল বডি, ছাত্রবিষয়ক উপদেষ্টাসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার উপস্থিত ছিলেন। তবে শিক্ষক সমিতির সঙ্গে উপাচার্য বৈঠক করেননি।
এ সময় ছাত্রলীগ আটক চারজনের মুক্তির দাবিতে সহস্রাধিক সাধারণ শিক্ষার্থী নিয়ে ক্যাম্পাসে মিছিল করে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান ধর্মঘট শুরু করে। বিকেল পাঁচটার দিকে উপাচার্য ছাত্রলীগের সঙ্গে বৈঠক করেন।
ওই বৈঠকে উপস্থিত ছাত্রলীগের নেতা ও শিক্ষকদের সূত্র জানায়, বৈঠকে ছাত্রলীগ গতকাল আটক হওয়া চার কর্মীর মুক্তি এবং ছাত্রবিষয়ক উপদেষ্টা ও প্রক্টরের পদত্যাগ, ছাত্রলীগের কর্মীদের আটকের সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান। দাবি অনুযায়ী সন্ধ্যা সাতটার দিকে উপাচার্যের নির্দেশে ছাত্রবিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তাফিজুর রহমান কোতোয়ালি থানা থেকে ওই চারজনকে ছাড়িয়ে আনেন।
বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি শামছুদ্দিন আল আজাদ ও সাধারণ সম্পাদক রফিকুজ্জামান ইমন এ বিষয়ে বলেন, ‘ছাত্রলীগ এ ঘটনার সঙ্গে কোনোভাবেই জড়িত নয়। কোনো প্রকার তদন্ত কমিটি ছাড়া শিক্ষকদের ছাত্র প্রহার ও ধরপাকড়ের ঘটনা পুরোপুরি অন্যায়। কাজেই সাধারণ ছাত্রদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে আমরা ওই ছাত্রদের মুক্তি দাবি করেছি। এ ঘটনায় আমরা প্রক্টরসহ প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট সবার ও জড়িত শিক্ষকদের পদত্যাগ দাবি করেছি।’
প্রক্টর আবু হাদী নূর আলী খান বলেন, জড়িত সবাইকে শাস্তির আওতায় আনা হবে। তাঁর পদত্যাগ দাবির বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
ছাত্রবিষয়ক উপদেষ্টা বলেন, ‘দুঃখের কথা আর কী বলব! ছাত্রদের হাতে আজকের আমার এই গণপিটুনির কথা কোনো দিন ভুলব না।’ তিনি এ ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বলেন, পরিস্থিতি এখন শান্ত রয়েছে।
শিক্ষক সমিতির সভাপতি নজরুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক মো. সামছুল আলম জানান, প্রক্টরের বাসায় হামলার প্রতিবাদে ও জড়িতদের শাস্তির দাবিতে দুপুর থেকেই অনির্দিষ্টকালের জন্য সব ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে শিক্ষক সমিতি। আজ মঙ্গলবার বেলা ১১টায় আবার বৈঠক করে পরবর্তী কর্মসূচি নেওয়া হবে।
ঘটনার বিষয়ে জানতে উপাচার্য এম এ সাত্তার মণ্ডলের সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গোলাম সারোয়ার বলেন, ‘রোববার ছিনতাইয়ের অভিযোগে আটক দুই ছাত্রের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। গতকাল চার ছাত্রকে শিক্ষকেরা দুপুরে আমাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন, ইফতারের সময় শিক্ষকেরাই আবার তাঁদের ছাড়িয়ে নিয়ে গেছেন।’ তিনি বলেন, ক্যাম্পাসে অতিরিক্ত চার প্লাটুন পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।
প্রথম আলো

Twitter Delicious Facebook Digg Stumbleupon Favorites More