Total Pageviews

Feedjit Live

Wednesday, July 6, 2011

‘পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ’


undefined
একটি দেশ কতটা গণতান্ত্রিক, তা নিরূপিত হয় সেই দেশের সিভিল সোসাইটি বা নাগরিক সমাজের শক্তি-সামর্থ্য ও কার্যকর ভূমিকার ওপর। যে দেশে নাগরিক সমাজ যত শক্তিশালী, সে দেশের গণতন্ত্রও তত মজবুত বলে ধরে নেওয়া হয়। এ প্রসঙ্গে আমরা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মার্কিন নাগরিক সমাজের সাহসী ভূমিকা স্মরণ করতে পারি। মার্কিন সরকার মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করলেও সে দেশের নাগরিক সমাজ স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের সমর্থন করেছে এবং অনেক সময় সিদ্ধান্ত পরিবর্তনেও সরকারকে বাধ্য করেছে। আমরা তুলনা করতে পারি অধুনা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে। পাকিস্তানে নাগরিক সমাজ দুর্বল বলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাও ভঙ্গুর। ভারতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা টেকসই বলে সেখানে শক্তিশালী নাগরিক সমাজ গড়ে উঠেছে। আন্না হাজারে ও রামদেবের সাম্প্রতিক দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। অনশনকারী আন্না হাজারেকে লাঠিপেটা না করে সরকার তাঁর দাবি মেনে লোকপাল প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেয়। একই সঙ্গে তিনি প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বাংলাদেশে এ দৃশ্য ভাবা যায় না। এখানে কেউ সরকারপ্রধানের সঙ্গে দেখা করলে আওয়ামী লীগের দালাল এবং বিরোধীদলীয় নেতার সঙ্গে বৈঠক করলে বিএনপির এজেন্ট হয়ে যাবেন। অর্থাৎ, মানুষকে মাপা হয় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাটখারায়। যেন এই দুই দলের বৃত্তের বাইরে কেউ থাকতে পারেন না। তবে এই অপবাদের জন্য নাগরিক সমাজের সুবিধাবাদিতাও কম দায়ী নয়। তারা নিজ নিজ সুবিধামতো কখনো দলীয় হয়, কখনো নাগরিক সমাজের ভূমিকা পালন করে, কখনো নিরপেক্ষ থাকে।
নাগরিকমাত্রই নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি নন। যে দেশে বিশাল জনগোষ্ঠী সব ধরনের নাগরিক-মানবিক অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত, সে দেশে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা এক অর্থে সুবিধাভোগী। অন্তত তাঁরা সামাজিকভাবে এমন অবস্থানে আছেন, যাঁরা অন্যের অধিকার ও সুযোগের কথাটি ভাবতে পারেন। জনগণের অগ্রসর অংশ হিসেবে এটি তাঁদের নৈতিক ও মানবিক দায়িত্বও বটে। সাধারণত লেখক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাংবাদিক, চিকিৎসক, আইনবিদ, কৃষিবিদ, প্রকৌশলীসহ বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার অগ্রসর অংশকে নাগরিক সমাজ ভাবা হয়। তবে শর্ত হলো, তাঁরা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরাসরি জড়িত হবেন না, রাষ্ট্রক্ষমতা ভোগ করবেন না। নাগরিক সমাজ বিবেকের তাড়নায় তাদের দায়িত্ব পালন করবে। সমাজে ন্যায় ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করবে।
আমাদের দেশে পাকিস্তান আমল থেকে নাগরিক সমাজ সক্রিয় ও সাহসী ভূমিকা রেখে আসছে। আমরা যদি ভাষা আন্দোলনের দিকে তাকাই, দেখব, তা ছিল প্রকৃতই একটি নাগরিক উদ্যোগ। আমরা যদি ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রজন্মশত বর্ষ উদ্যাপন কিংবা ১৯৬৭ সালে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার বন্ধের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলনের দিকে তাকাই, সেখানেও নাগরিক সমাজের মুখ্য ভূমিকা ছিল। রাজনীতিকেরা এসেছেন পরে, পেছনে পেছনে।

২.
স্বাধীন বাংলাদেশে নাগরিক সমাজের সবচেয়ে সক্রিয় ও কার্যকর ভূমিকা ছিল আশির দশকে। স্বৈরাচারী এরশাদ শহীদ মিনারে ফুল দেওয়া, আলপনা আঁকা ইত্যাদি বেদাত কাজ বলে ফরমান জারি করলে এ দেশের লেখক, শিল্পী, শিক্ষাবিদ তথা নাগরিক সমাজ প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে, যা সাংগঠনিক রূপ পায় ‘সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট’ নামে। সে সময় কেবল সংস্কৃতিসেবী নন, লেখক, আইনবিদ, চিকিৎসক, কৃষিবিদ, শিক্ষকসহ বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষও গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় জোরালো ভূমিকা রেখেছিলেন। আমরা স্মরণ করতে পারি ৩১ জন বুদ্ধিজীবীর সেই বিখ্যাত বিবৃতির কথা, যা স্বৈরাচারী এরশাদের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। তাঁরা ছিলেন বিভিন্ন মতের অনুসারী। সাতাশি, আটাশি, ঊননব্বই ও নব্বইয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও রাজনীতিকদের পাশাপাশি নাগরিক সমাজ প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছিল। বুদ্ধিজীবীদের দৃঢ়প্রত্যয় এবং পেশাজীবীদের সম্মিলিত আন্দোলন রাজনীতিকদের সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। সেদিন সাংবাদিকেরা এরশাদের কঠোর সেন্সরশিপের প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন কলম বন্ধ রেখে। নব্বইয়ের জরুরি অবস্থায় ২৭ নভেম্বর থেকে ৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশে কোনো পত্রিকা প্রকাশিত হয়নি। এখন সাংবাদিক সমাজও বহুধাবিভক্ত। সাংবাদিকতা পেশায় দলীয়করণের পাশাপাশি দুর্বৃত্তায়নও ঢুকে গেছে। যাঁরা পেশার প্রতি সৎ ও বস্তুনিষ্ঠ, তাঁদের নানাভাবে নাজেহাল হতে হয়। অপপ্রচার ও আক্রমণের শিকার হতে হয়।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, ১৯৯১ সালে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার পরই নাগরিক সমাজের সেই সাহসী ভূমিকা আর লক্ষ করা যায়নি। নাগরিক সমাজের অধিকাংশ প্রতিনিধি এখন ‘এ-দলে ও-দলে’ ভাগ হয়ে সুবিধা আদায়ে ব্যস্ত। ক্ষমতা বদলের পর কেউ কেউ লোভনীয় পদে আসীন হন; যাঁরা এখন বঞ্চিত, তাঁরা পরবর্তী সরকারের জন্য অপেক্ষা করেন। বিএনপির আমলে ড্যাব, আওয়ামী লীগের আমলে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ সারা দেশে চিকিৎসকদের পদায়ন ও পদোন্নতি দেয়। এভাবে প্রতিটি পেশাজীবী গোষ্ঠী আওয়ামী লীগ ও বিএনপি শিবিরে বিভক্ত হয়ে আছে। ১৯৯৮ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরোধিতাকারী ১০১ জন বুদ্ধিজীবী নিয়ে একটি নাগরিক ফোরাম গঠিত হওয়ার পর ২০১ জন নিয়ে পাল্টা নাগরিক সংগঠন করা হয় সরকারের সমর্থনে। আমাদের জানতে ইচ্ছে করে, আওয়ামী লীগের প্রতি দরদ উথলে ওঠা সেই ২০১ বৃদ্ধিজীবী এখন কে কোথায় আছেন।
অধুনা বিএনপিপন্থী ১০১ সদস্যের নাগরিক ফোরাম আবার সক্রিয় হয়েছে। তারা এখন ‘হাওয়া ভবন’ নেতার মুক্তির দাবিতে সেমিনার-সভায় গরম বক্তব্য দিলেও বিএনপির আমলে দেশব্যাপী বোমা-গ্রেনেড হামলা কিংবা রাজনৈতিক হত্যা, সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করেনি। আবার সেদিন যাঁরা বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাস ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন, তাঁরা এখন চুপচাপ। তাঁদের কেউ ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে আঁতাত করে নানা পদ-পদবি বাগিয়ে নিয়েছেন, আবার কেউ ‘কিছুই পেলাম না’ বলে হতাশ হয়ে ঘরে বসে আছেন।

৩.
দেশের ক্রান্তিকালে নাগরিক সমাজের কাছে সৎ, সক্রিয় ও কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা প্রত্যাশিত। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ সেই ভূমিকা রাখতে পেরেছে বলে মনে হয় না। তাদের অধিকাংশ ‘একের ভেতরে তিন’— নাগরিক সমাজের সদস্য, এনজিওর কর্মকর্তা এবং রাজনৈতিক দলের আস্থা বা বিরাগভাজন। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি বলে পরিচিত আইনজীবীরা আদালত চত্বরে মারামারি করেন, সাংবাদিকেরা ভাগ হয়ে ‘জিন্দাবাদ’ ‘মুর্দাবাদ’ স্লোগান দেন, শিক্ষকেরা নীল-সাদা দলে ভাগ হয়ে পদ-পদবির জন্য উন্মুখ থাকেন। তাঁদের বিবেক পাঁচ বছরের জন্য জাগ্রত ও পাঁচ বছরের জন্য ঘুমন্ত থাকে। নাগরিক সমাজের ‘অব.’ নামে আরেক শ্রেণীর প্রতিনিধি আছেন, যাঁরা স্বৈরাচারী-আধাস্বৈরাচারী সব সরকারের গুণকীর্তন করে এখন জাতির বিবেক সেজেছেন। তাঁদের অনেকে বিভিন্ন এনজিওর সঙ্গে যুক্ত।
নাগরিক সমাজের অংশ হিসেবে এনজিওগুলো কতটা স্বাধীন ভূমিকা রাখতে পারে, সে ব্যাপারেও সংশয় আছে। তারা সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে কাজ করে। বেসরকারি সংস্থার অর্থ ছাড়ে, রেজিস্ট্রেশন নবায়নে কতগুলো প্রতিষ্ঠানের কাছে জবাবদিহি করতে হয়, সেগুলো দেখা নিশ্চয়ই নাগরিক সমাজের কাজ নয়। নাগরিক সমাজ কথা বলবে সরকারি-বেসরকারি নির্বিশেষে সত্য, ন্যায় ও মানবাধিকারের পক্ষে, গণতন্ত্রের পক্ষে। তাদের ভূমিকা হবে যাত্রাপালার বিবেকের মতো। সত্য বলে যাবে। তারা বিদেশি শক্তির এজেন্ডা বা প্রকল্প নিয়ে কাজ করবে না। তারা সরকারের এজেন্ডা নিয়েও কাজ করবে না। কাজ করবে জনগণের এজেন্ডা নিয়ে। সম্প্রতি ভারতে আন্না হাজারে যে কাজটি করেছেন, বিনায়ক সেন যে কাজটি করেছেন, সেটিই হলো প্রকৃত নাগরিক সমাজের দায়িত্ব। এ কাজ ব্যক্তির উদ্যোগে হতে পারে, সাংগঠনিকভাবে হতে পারে। বাংলাদেশে সে রকম কাউকে এগিয়ে আসতে দেখা যায় না। কেন? আমাদের সমাজে কি সাহসী মানুষের অভাব? মোটেই না। কিন্তু একজন অরুন্ধতী রায় কিংবা বিনায়ক সেন তৈরি হতে যে ভয়মুক্ত পরিবেশ দরকার, সেই পরিবেশ বাংলাদেশে এখন অন্তত নেই।

৪.
সম্প্রতি নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তারা সরকারের নানামুখী চাপে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাঁরা বলেছেন, গণতন্ত্র ও সুশাসন নিশ্চিত করতে শক্তিশালী নাগরিক সমাজের বিকল্প নেই। কয়েক মাস আগে টিআইবি বিচার বিভাগ নিয়ে একটি জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করলে আদালত তাদের কাছে কৈফিয়ত তলব করেন। কয়েকটি স্থানে মামলা হয়। শেষ পর্যন্ত বিচারক কমিটির কাছে তাদের জবাবদিহিও করতে হয়। বাংলাদেশ সফরে আসা ইউরোপীয় ইউনিয়নের মন্ত্রী, জার্মানি ও যুক্তরাজ্যের মন্ত্রীরাও গণতন্ত্র টেকসই করতে শক্তিশালী নাগরিক সমাজের গুরুত্বের কথা বলেছেন। নাগরিক সমাজ মানেই বহু মত, তর্ক-বিতর্ক, সমালোচনা। সরকার যদি কোনো সমালোচনাই সহ্য না করে, তারা যা করছে সেটাই উত্তম ভাবে, তাহলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সংহত হবে কী করে? আমাদের রাজনীতিতে ভিন্নমতের সুযোগ নেই। দলীয় নেতা বা নেত্রী যা বলেন, সেটাই শেষ কথা। সে ক্ষেত্রে ভিন্নমত ও সমালোচনা আসতে পারে নাগরিক সমাজ থেকে।
বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ এখন উচ্চকণ্ঠ, তা বলা যাবে না। অনুচ্চ, ক্ষীণ তাদের কণ্ঠ। তার পরও সরকার কিংবা বিরোধী দল তাদের সহ্য করতে পারে না। বিচারবহির্ভূত হত্যা, দলীয় মাস্তানি, হরতাল-অবরোধ ইত্যাদির বিরুদ্ধে কথা বললেই নেতা-নেত্রীরা খড়্গহস্ত হন। ধমক দিয়ে, চাপ দিয়ে কিংবা উৎকোচ ও উপঢৌকন দিয়ে সমালোচনা বন্ধ করতে চান। স্তব্ধ করতে চান ভিন্নমতের কণ্ঠস্বর। আমরা এমন গণতন্ত্র চাই না, যে গণতন্ত্রে মানুষ কথা বলতে ভয় পায়, সরকারের সমালোচনা করলে জেল খাটতে বা হয়রানির শিকার হতে হয়। গণতান্ত্রিক দেশে কখনোই নাগরিক সমাজের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায় না। যদি ফুরিয়ে যায়, বুঝতে হবে আমাদের কপালে আরও অনেক দুঃখ আছে।
মাছের পচন ধরে যেমন মাথা থেকে, সমাজের পচন ধরে তার মাথা অর্থাৎ লেখক, বুদ্ধিজীবী, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, সাংবাদিক তথা নাগরিক সমাজ থেকে। সরকার ভুল করলে, বিরোধী দল ভুল করলে; আমলাতন্ত্র, পুলিশ বাহিনী বা ব্যবসায়ীরা অন্যায় করলে মানুষ যাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকে, তাঁরা হলেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি। কিন্তু তাঁরাই যদি ভুল পথে চালিত হন, নিশ্চুপ থাকেন, তাহলে জনগণের ভরসাস্থল বলে কিছু থাকে না। বাংলাদেশের দিগ্ভ্রান্ত নাগরিক সমাজের বর্তমান ভূমিকা দেখে বঙ্কিম চন্দ্রেরকপাল কুণ্ডলা উপন্যাসে নবকুমারকে লক্ষ্য করে নায়িকার বিখ্যাত উক্তির কথাই মনে হয়: ‘পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ’।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohৎab03@dhaka.net

0 comments:

Post a Comment

Twitter Delicious Facebook Digg Stumbleupon Favorites More