Total Pageviews

Feedjit Live

Monday, July 4, 2011

আত্মসমর্পণের পর কারাগারে সাবেক তিন আইজিপি


  • শহুদুল হক
  • আশরাফুল হুদা
  • খোদা বখশ চৌধুরী
1 2 3
২১ আগস্টে গ্রেনেড হামলা মামলার আসামি পুলিশের তিন সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) শহুদুল হক, আশরাফুল হুদা ও খোদা বখ্স চৌধুরীকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
চারদলীয় জোট সরকারের আমলে আইজিপির দায়িত্ব পালনকারী এই তিন কর্মকর্তা গতকাল সকালে আত্মসমর্পণ করলে আদালত তাঁদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। আদালত তাঁদের জামিনের আবেদন নাকচ করেন।
পুলিশের এই সাবেক তিন আইজিসহ ৩০ জনকে নতুন আসামি করে গত রোববার এই মামলায় সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি। অভিযোগপত্র দাখিলের পর এই তিন কর্মকর্তাসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি করা হয়। তবে সেই পরোয়ানা কার্যকর হওয়ার আগেই পুলিশের তিন সাবেক কর্মকর্তা আদালতে হাজির হন। বাকি ১৫ আসামির ঠিকানায় গতকাল সন্ধ্যায় পুলিশের মাধ্যমে পরোয়ানা পাঠানো হয়েছে বলে আদালত সূত্র জানায়।
সম্পূরক অভিযোগপত্রে নাম আসা পাঁচ পুলিশ কর্মকর্তার মধ্যে বাকি দুজন চাকরিতে থাকায় তাঁদের বিরুদ্ধে কী ধরনের আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে, তা জানতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর।
সিআইডির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হওয়া আসামিদের মধ্যে পাঁচজন বিদেশে অবস্থান করছেন বলে তাঁদের কাছে তথ্য রয়েছে। বাকি আসামিদের অবস্থান সম্পর্কে তাঁরা এখনো কিছু জানেন না।
কারাগারে তিন সাবেক আইজিপি: পুলিশের তিন সাবেক আইজি শহুদুল হক, আশরাফুল হুদা ও খোদা বখ্স চৌধুরী গতকাল পৃথক গাড়িতে করে আদালতে হাজির হন। তাঁরা ঢাকার মহানগর হাকিম কেশব রায় চৌধুরীর আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। তাঁদের পক্ষে আইনজীবী রফিক-উল হক ও আমিনুল গনি আদালতে জামিনের আবেদন করেন। আদালত আবেদন নামঞ্জুর করে তাঁদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
জামিন শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষে কৌঁসুলি ছিলেন সৈয়দ রেজাউর রহমান, আবদুল্লাহ আবু, মোকলেসুর রহমান ও আবদুর রহমান।
শুনানিতে আসামি আশরাফুল হুদার আইনজীবী আমিনুল গনি বলেন, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট মুক্তাঙ্গনে সমাবেশ করার কথা ছিল। সে অনুযায়ী পুলিশ মুক্তাঙ্গনে অনুষ্ঠানের অনুমতি দিয়েছিল। কিন্তু পরে কীভাবে সমাবেশস্থল পরিবর্তন করা হলো, অভিযোগপত্রে তার কিছুই উল্লেখ নেই।
আইনজীবী আমিনুল বলেন, এই তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁরা ঘটনাস্থলে নিরাপত্তা দেননি। এই অভিযোগ যদি সত্য হয়, তবে তাঁদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হতে পারে, এই মামলা নয়। কারণ, তাঁরা ঘটনাস্থলে উপস্থিতও ছিলেন না। তাঁদের কেউ গ্রেনেডও ছোড়েননি। কোনো সাক্ষীর জবানবন্দিতে তাঁদের কোনো সংশ্লিষ্টতার কথাও আসেনি। তিনি বলেন, ঘটনার দিন সকালে আশরাফুল হুদা একটি আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণ কর্মশালায় অংশ নিতে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে রওনা হন।
আশরাফুল হুদা ২০০৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর থেকে পরের বছরের ৭ এপ্রিল পর্যন্ত তিন মাস দুই দিন পুলিশের মহাপরিদর্শকের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছিলেন।
রফিক-উল হক বলেন, ‘মামলার এজাহারে শহুদুল হক ও খোদা বখ্স চৌধুরীর নাম নেই। মূল অভিযোগপত্রেও এঁদের নাম ছিল না। কিসের ভিত্তিতে দ্বিতীয় অভিযোগপত্রে এঁদের নাম এসেছে, তা আমরা জানতে পারিনি। পত্রপত্রিকা পড়ে জেনেছি, নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় তাঁদের জড়ানো হয়েছে।’
রফিক-উল হক বলেন, ২০০৪ সালে এঁরা দুজনেই স্বাভাবিক অবসর নিয়েছেন। দুজনেই এখন অসুস্থ। জামিন না হলেও আদালতের কাছে প্রার্থনা, তাঁদের ইব্রাহিম কার্ডিয়াক ও বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসার সুযোগ দেওয়া হোক।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সৈয়দ রেজাউর রহমান জামিনের বিরোধিতা করে বলেন, ‘আসামিরা ঘটনার সময় তাঁদের দায়িত্ব পালন করেননি। ঘটনায় অংশ নেওয়া জঙ্গিদের নিরাপদে পালিয়ে যাওয়ার জন্য সহায়তা করেছেন। মামলাটি স্পর্শকাতর। কারণ, তখনকার বিরোধী দল আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতেই শেখ হাসিনাসহ দলটির কেন্দ্রীয় নেতাদের ওপর হামলা করা হয়। আসামিদের বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য-প্রমাণ রয়েছে। এই অবস্থায় জামিনের ঘোর বিরোধিতা করছি।’
দুই আসামির চিকিৎসার দাবির বিষয়ে সৈয়দ রেজাউর রহমান বলেন, কেন্দ্রীয় কারাগারে চিকিৎসার সুব্যবস্থা আছে। কারা কর্তৃপক্ষ প্রয়োজন মনে করলে বাইরে চিকিৎসার উদ্যোগ নেবে।
বিচারক আসামিদের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। একই সঙ্গে কারা বিধি অনুযায়ী তাঁদের প্রাপ্য শ্রেণী ও সুবিধা দেওয়ার ব্যবস্থা নিতে কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন আদালত।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীকে সহায়তা করেন মহানগর পিপি আবদুল্লাহ্ আবু, মোখলেসুর রহমান ও আবদুর রহমান।
পরোয়ানার আসামিরা কে কোথায়: সম্পূরক অভিযোগপত্রের ৩০ আসামির মধ্যে ১২ জন কারাগারে আছেন। বাকি ১৮ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। তাঁদের মধ্যে তিনজন গতকাল আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। বাকি ১৫ আসামির মধ্যে তারেক রহমান ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনুমতি নিয়ে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যান। এর পর থেকে তিনি যুক্তরাজ্যে আছেন।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল থেকেই পলাতক আছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রথম দিকে তিনি ভারতের আসাম রাজ্যের করিমগঞ্জে ছিলেন বলে সিলেটের স্থানীয় পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছিল। আবার তিনি লন্ডনে আছেন বলেও একাধিক সূত্র জানিয়েছে। তবে কেউ তাঁর সঠিক অবস্থান সম্পর্কে কিছু বলতে পারেননি।
বিএনপির সাংসদ কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসাইন কায়কোবাদ বর্তমানে সৌদি আরবে আছেন। তাঁর পারিবারিক সূত্র জানায়, বাসার সিঁড়িতে পড়ে কোমর ভেঙে যাওয়ায় তিনি দুই বছর ধরে ব্যাংককে চিকিৎসা নিচ্ছেন। সম্প্রতি তিনি ওমরাহ হজ করার জন্য সেখান থেকে সৌদি আরবে গেছেন।
ডিজিএফআইয়ের কাউন্টার টেররিজম ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর (সিটিআইবি) সাবেক পরিচালক এ টি এম আমিন বর্তমানে দুবাইতে আছেন বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলের আলোচিত এই সেনা কর্মকর্তা ২০০৯ সালের ১৭ মে অকালীন অবসরে যান।
গত বিএনপি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ডিজিএফআইয়ের একই শাখায় কর্মরত সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দারকে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর চাকরিচ্যুত করা হয়। এরপর তিনি আত্মগোপনে চলে যান। সিআইডির তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, চাকরিচ্যুতির পরদিন তিনি সপরিবারে দুবাইতে চলে যান। বর্তমানে তিনি সেখানে নির্মাণব্যবসা করেন।
প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে খালেদা জিয়ার একান্ত সচিব ও ভাগনে সাইফুল ইসলাম ওরফে ডিউক বর্তমানে কারাগারে আছেন।
‘জজ মিয়া’ নাটকের অন্যতম রূপকার হিসেবে পরিচিত সিআইডির তৎকালীন বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, সহকারী পুলিশ সুপার আবদুর রশিদ ও মুন্সি আতিকুর রহমান। মুন্সি আতিক ফরিদপুরে ও আবদুর রশিদ বগুড়ায় গ্রামের বাড়িতে আছেন। রুহুল আমিন আছেন ঢাকায়।
মামলার আরেক আসামি রাতুল বাবু বর্তমানে দক্ষিণ আফ্রিকায় আছেন। তিনি এ মামলায় গ্রেপ্তার থাকা আসামি সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই। এঁদের আরেক ভাই মাওলানা তাজউদ্দিনও এ মামলার আসামি। তিনি বিগত জোট সরকারের শেষ দিকে কতিপয় গোয়েন্দা কর্মকর্তার সহায়তায় বেনামি পাসপোর্টে পাকিস্তানে চলে যান বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ আছে।
হানিফ পরিবহনের মালিক মো. হানিফ ঢাকায় আছেন। অভিযোগপত্রে নাম থাকার তথ্য জানার পর তিনি গা ঢাকা দেন।
মুফতি শফিকুর রহমান ও আবদুল হাই দেশেই আছেন। শফিকুর রহমানের বাড়ি কিশোরগঞ্জের ভৈরবে। আবদুল হাইয়ের বাড়ি কুমিল্লার দাউদকান্দিতে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর নিষিদ্ধ হরকাতুল জিহাদের এই সাবেক দুই আমির গা ঢাকা দেন।
দুই পুলিশ কর্মকর্তা: আসামি অতিরিক্ত ডিআইজি খান সাঈদ হাসান বর্তমানে পুলিশ সদর দপ্তরে সংযুক্ত (ওএসডি) আছেন। তিনি হাওয়া ভবনের ঘনিষ্ঠ ছিলেন বলে প্রচার আছে। আরেক আসামি পুলিশ সুপার ওবায়দুর রহমানও ওএসডি আছেন। এ দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কী ধরনের আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে, সে ব্যাপারে পরামর্শ চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর।
পুলিশের অতিরিক্ত আইজি (প্রশাসন) এ কে এম শহীদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, এঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়ার বিষয়টি মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের পর তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রেড নোটিশ: মামলার পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তারে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের মাধ্যমে পরোয়ানা পাঠানো হবে। তবে এখন পর্যন্ত এ-সংক্রান্ত কাগজপত্র পুলিশের হাতে পৌঁছায়নি। আদালতের পরোয়ানা হাতে আসার পরই এসব ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার প্রথম আলোকে বলেছেন।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার সমাবেশে এই গ্রেনেড হামলায় ২২ জন নেতা-কর্মী নিহত হন। আহত হন কয়েক শ লোক। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় এ মামলার তদন্ত বারবার ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকার নতুন করে এ মামলার তদন্ত শুরু করে। ২০০৮ সালের ১১ জুন সিআইডি অভিযোগপত্র দেয়। এতে হরকাতুল জিহাদের অন্যতম শীর্ষ নেতা মুফতি হান্নান, বিএনপি সরকারের সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ২২ জনকে আসামি করা হয়।
ওই অভিযোগপত্রভুক্ত আট আসামি পলাতক আছেন। এঁদের মধ্যে যমজ ভাই মোত্তাকিন ও মোরসালিন ভারতের কারাগারে আটক আছেন।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর এ মামলার অধিকতর তদন্ত হয়। গত রোববার আরও ৩০ জনকে আসামি করে আদালতে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। এ নিয়ে মামলার মোট আসামির সংখ্যা হলো ৫২ জন।

0 comments:

Post a Comment

Twitter Delicious Facebook Digg Stumbleupon Favorites More