Total Pageviews

Feedjit Live

Tuesday, June 28, 2011

সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নয়, এটি মসজিদ


মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার বাহারপুর জামে মসজিদ। একে জাপান-বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র দেখিয়ে জাপান থেকে সাড়ে ছয় কোটি টাকা অনুদান এনে আত্মসাত্ করেছেন দারাদ আহমেদ
ছবি: আনিস মাহমুদ
দারাদ আহমেদ। বিশ্বভারতী থেকে স্নাতকোত্তর। সেখানকার ছাত্র-সংসদের নির্বাচিত সাবেক সাধারণ সম্পাদক। বিএনপির কেন্দ্রীয় আন্তর্জাতিক ও সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক। জাপান বিএনপির সভাপতি। এসব তাঁরই দাবি।
তবে মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার দারাদ আহমেদের গ্রামের লোকজন জানান, দারাদ সপ্তম শ্রেণী পাস। আসল নাম বদরুল ইসলাম।
এই দারাদই জাপান-বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র তৈরির জন্য জাপানের কাযুও আজুমা দম্পতির কাছ থেকে সাড়ে ছয় কোটি টাকা নিয়ে আত্মসাৎ করেছেন। আর এ জন্য তিনি তাঁর বাড়ির সামনের মসজিদটির ছবি তুলে তা জাপানে পাঠান। তিনি জানান, এটিই হচ্ছে তাঁর স্বপ্নের জাপান-বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।
মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলায় অনুসন্ধান করে এ ঘটনা জানা গেছে। জাপানি অধ্যাপক আজুমা দম্পতি প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, তাঁদের কাছে সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের ২০টি ছবি পাঠিয়েছেন দারাদ। জানিয়েছিলেন, বড়লেখায় এই কেন্দ্র তৈরি করা হয়েছে। 
তবে বড়লেখার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, শিক্ষক, সাধারণ মানুষ দারাদের সন্ধান জানালেও এলাকায় জাপান-বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কোনো সন্ধান দিতে পারেননি। এমনকি ছবি দেখানোর পরও তাঁরা বলতে পারেননি, এই সাংস্কৃতিক কেন্দ্রটি কোথায়?
এলাকাবাসী জানালেন, দারাদ আহমেদের গ্রামের বাড়ি মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলার তালিমপুর ইউনিয়নের বাহারপুর গ্রামে। ওই বাড়ির কাছাকাছি গিয়ে ছবিগুলো দেখালে গ্রামের কিশোর তাজউদ্দিন বলল, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নয়, এগুলো বাহারপুর জামে মসজিদের ছবি।
মসজিদের সামনে গিয়ে ছবিগুলো মিলিয়ে দেখা যায়, মসজিদের বিভিন্ন পাশ থেকে ছবিগুলো তোলা। কেন্দ্রের নামে এই ছবিগুলো পাঠিয়ে আজুমা দম্পতির কাছ থেকে তিনি সাড়ে ছয় কোটি টাকা এনেছেন। 
মসজিদটির বিষয়ে জানতে চাইলে তালিমপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সুনামউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মসজিদটি পাকা করা হয়েছে বছর দুয়েক আগে। এলাকার সব মানুষ মিলে চাঁদা তুলে টাকা দিয়ে এই মসজিদ বানাইছে।’ এখানে জাপান-বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র আছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার এলাকায় এমন কোনো কেন্দ্র নেই। এটা দারাদের প্রতারণা।’
বাহারপুর জামে মসজিদের ইমাম আবদুস শহীদও জানান, ‘কোনো কেন্দ্র নয়, এটি মসজিদ।’
মসজিদের ছবি তোলার সময় হাজির হলেন মধ্যবয়সী এক লোক। নিজের নাম জানালেন মুরাদ আহমেদ। তিনি দারাদ আহমেদের ভাই। মসজিদ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এলাকার সবাই মিলে টাকা দিয়ে এই মসজিদ করেছে। কিন্তু বেশির ভাগ টাকাই দিছে আমাদের গোষ্ঠীর লোকজন।’ এই মসজিদকে জাপান-বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র দেখানোর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কথা বলতে রাজি হননি।
এলাকার সাংস্কৃতিককর্মী হিসেবে পরিচিত তপন চৌধুরীর নামও জাপান-বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সদস্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। যোগাযোগ করা হলে তপন চৌধুরী বলেন, ‘এলাকায় জাপান-বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র বলে কিছু আছে, তা আমার জানা নেই। আর আমাকে না জানিয়েই আমার নাম ব্যবহার করা হয়েছে।’
একজন প্রতারক: ২০০৮ সালের নির্বাচনে দারাদ আহমেদ বিএনপির হয়ে এই আসন থেকে মনোনয়ন নেওয়ার চেষ্টা করেন। নির্বাচনের আগে তিনি নিজেকে বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক ও আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক বলে পরিচয় দেন। এ সময় তিনি এলাকায় যে প্রচারপত্র (লিফলেট) বিলি করেন, তাতে বলেন, শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী ছাত্র-সংসদের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। এই সুবাদে ভারতের অনেক প্রধানমন্ত্রী এবং গান্ধী পরিবারসহ অনেকের সঙ্গেই তাঁর ঘনিষ্ঠতা আছে। নিজেকে বিএনপির জাপান শাখার সভাপতি হিসেবেও পরিচয় দেন তিনি।
দারাদ বর্তমানে উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও বিএনপির সহযোগী সংগঠন জাতীয়তাবাদী সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংস্থার (জাসাস) কেন্দ্রীয় কমিটির সহসাধারণ সম্পাদক।
দারাদ সম্পর্কে জানতে চাইলে ওই এলাকার সাবেক প্রতিমন্ত্রী এবাদুর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘দারাদকে আমি প্রথম দেখি ২০০২ সালের দিকে। তখন আমি ত্রাণ ও দুর্যোগবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী। তিনি একদিন সচিবালয়ে এসে আমার সঙ্গে দেখা করেন এবং নিজেকে রবীন্দ্রনাথ বিশেষজ্ঞ বলে পরিচয় দেন। জাপানি অধ্যাপক আজুমা ও তাঁর স্ত্রীকেও তিনি নিয়ে এসেছিলেন।’
এবাদুর রহমান বলেন, ‘কিছুদিন পর দারাদ এসে আমাকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে তিনি একটি বিশাল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন। অনুষ্ঠানে জর্জ হ্যারিসন অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হবে। এতে ভারতের রবিশঙ্কর থাকবেন। আমাকে প্রধান অতিথি হতে হবে। কিন্তু আমি গিয়ে দেখলাম, একটি ছোট্ট কলেজের অনুষ্ঠান। তাতে রবিশঙ্কর ছিলেন না। আর পদকের বিষয়টিও ছিল ভুয়া। তখনই আমার মনে হয়, এটি প্রতারণা। এ ঘটনার পর ২০০৪ বা ২০০৫ সালের দিকে আমি জাপানের একজন মেয়রের আমন্ত্রণে দেশটিতে যাই। তখন টোকিওতে আমার সঙ্গে দেখা করেন দারাদ। সে সময় আজুমা পরিবারের সঙ্গে আমি তাঁর হূদ্যতা দেখেছি।’
এলাকায় দারাদের রাজনীতি সম্পর্কে জানতে চাইলে এবাদুর রহমান বলেন, ‘আমি যতটুকু জানি, তিনি নাইন বা টেন পর্যন্ত পড়েছেন। স্কুলে তাঁর নাম ছিল বদরুল ইসলাম। কিন্তু কীভাবে দারাদ হলো জানি না। ২০০৮ সালের নির্বাচনে তিনি বিএনপি থেকে মনোনয়ন নেওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় তিনি নিজেকে বিএনপির আন্তর্জাতিক ও কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক সম্পাদক হিসেবে পরিচয় দিতেন। কিন্তু তিনি এই পদে ছিলেন না।’ এলাকায় জাপান-বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র আছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার এলাকায় এমন কোনো কেন্দ্র থাকলে আমিই আগে জানতাম।’ 
বড়লেখা উপজেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল হাফিজও বলেন, বড়লেখায় এমন কোনো সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নেই।
দারাদ নিজেকে সাইফুর রহমানের আত্মীয় বলেও প্রচার চালান। এ বিষয়ে জানতে চাইলে এম নাসের রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘দারাদ আমার দলের কর্মী এবং বড়লেখা উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক। কিন্তু কোনোভাবেই আমাদের আত্মীয়স্বজন নন।’ দারাদের প্রতারণার বিষয়ে নাসের রহমান বলেন, ‘আমি তাঁকে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি, জাপানে কী করেন, কিন্তু তিনি পরিষ্কার করে কিছু বলেননি। বলতেন কম্পিউটার বিক্রি করি।’ 
দারাদকে বিশ্বভারতীতে দেখেছেন এমন একজন রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী প্রথম আলোকে বলেন, দারাদ অভিনয় শিখতে কিছুদিনের জন্য এসেছিলেন। তবে পড়ালেখা করেননি। ছাত্র-সংসদেরও কিছু ছিলেন না। ওখানে গন্ডগোল করে পালিয়ে যান।
মাকে নিয়েও প্রতারণা: জাপানি অধ্যাপক আজুমার কাছে দারাদ নিজের মাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন সার্জন ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কর্মকর্তা হিসেবে। কিন্তু এলাকার লোকজন জানান, দারাদের মা লেখাপড়াই জানেন না।
তালিমপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সুনামউদ্দিন এ বিষয়ে বলেন, ‘আমি এলাকার চেয়ারম্যান। ৪০ বছর ধরে এলাকায় আছি। সবার খোঁজখবর জানি। দারাদের বাড়িতে অনেকবার গেছি। তাঁর মা সার্জন তো দূরের কথা, লেখাপড়াই জানেন না। তিনি পুরোপুরি গৃহিণী। বয়স ৮০-৮৫ হবে।’
দারাদ যা বলেন: রবীন্দ্রনাথের বিষয়ে কেন এত আগ্রহ জানার জন্য দারাদ আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি একজন রবীন্দ্রপ্রেমী। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রসংগীতে অনার্স ও মাস্টার্স করেছি। এর পর থেকে রবীন্দ্রনাথের বিষয়ে আমার অনেক আগ্রহ।’ রাজনীতিতে কীভাবে এলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শান্তিনিকেতন ছাত্র-সংসদের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম আমি। এই সূত্রেই রাজনীতিতে আসা। ২০০৬ ও ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনেও মনোনয়ন চেয়েছিলাম। কিন্তু পাইনি। সামনে পেলে এলাকার মানুষের সেবা করব।’ জাপানি অধ্যাপক আজুমাকে চেনেন কি না, জানতে চাইলে দারাদ বলেন, ‘তাঁর সঙ্গে তো আমার বাবা-ছেলের সম্পর্ক।’
আজুমাকে জাপান-বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে টাকা এনেছিলেন কি না, জানতে চাইলে তিনি খেপে যান। বলেন, ‘অধ্যাপক আজুমা আমার বাড়িতে ছয়-সাতবার এসেছেন। তিনিই বড়লেখায় একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র করতে চেয়েছিলেন। তাঁকে জমি দেখিয়েছিলাম। কোনো টাকা নিইনি।’ এ নিয়ে কথা বলার একপর্যায়ে দারাদ বলেন, ‘এটি তো আমার আর আজুমার বিষয়। এখানে আপনি আসছেন কেন? উনি তো আর আপনার কাছে অভিযোগ করেননি।’
এসএসসি পাস না করে শান্তিনিকেতনে পড়লেন কীভাবে, জানতে চাইলে দারাদ বলেন, ‘এসএসসি পাস করেছি।’ কত সালে? ক্ষুব্ধ দারাদের উত্তর, ‘কাগজপত্র দেখে বলতে হবে। সব তো মুখস্থ থাকে না।’
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন মৌলভীবাজারের জুড়ী প্রতিনিধি কল্যাণ প্রসূন)

0 comments:

Post a Comment

Twitter Delicious Facebook Digg Stumbleupon Favorites More