Total Pageviews

Feedjit Live

Wednesday, October 5, 2011

খুনের পরিকল্পনায় খুলনা আ.লীগের চার নেতা!

ঠিকাদারি কাজের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে খুলনায় হত্যা-সন্ত্রাস অনেক পুরোনো বিষয়। তবে দুই বছর ধরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের কোন্দল দৃশ্যত কমে গেছে। চাঁদাবাজি ও ঠিকাদারি এখন নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে পরিকল্পিতভাবে, সাংগঠনিক উপায়ে।
প্রথম আলোর অনুসন্ধান ও জেলা আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার সূত্রে জানা গেছে, খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের চার শীর্ষস্থানীয় নেতা মিলে জেলার ঠিকাদারি ও পরিবহন ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন।
যেমন খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি কাজী আমিনুল হক একই সঙ্গে খুলনা চেম্বার অব কমার্স ও খুলনা ইউনাইটেড ক্লাবের সভাপতি। খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান খুলনা মিনিবাস মালিক সমিতির সভাপতি। খুলনা যুবলীগের আহ্বায়ক আনিসুর রহমান (পপলু) একই সঙ্গে আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও মিনিবাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক।
খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা ও ঠিকাদার জানিয়েছেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃত্ব আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। ঠিকাদারি কাজ ও পরিবহন চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণও তাঁদের হাতে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বড় ঠিকাদারি কাজের মধ্যে কে কোনটি পাবেন, তা সমঝোতার মাধ্যমে ঠিক করে দেন কাজী আমিনুল হক। তাঁর চাচাতো ভাই মোজহার কাজী গত আড়াই বছরে খুলনা ও বাগেরহাট এলাকার বেশির ভাগ বড় ঠিকাদারি কাজ পেয়েছেন। অভিযোগ আছে, কাজী আমিন নিজের প্রভাব কাজে লাগিয়ে চাচাতো ভাইয়ের নাম ব্যবহার করে এ কাজগুলো নিয়েছেন।
মাঝারি ও ছোট কাজ কে পাবেন, তা ঠিক করেন আনিসুর রহমান ও সাইফুল ইসলাম। এই নেতাদের উপদলে অবস্থান করা ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতারাও চাঁদাবাজির ভাগ পান বলে অভিযোগ আছে।
যোগাযোগ করা হলে আমিনুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ব্যবসায়ীদের সংগঠনের সভাপতি হিসেবে ঠিকাদারসহ সবার সমস্যা আলোচনার মাধ্যমে তিনি সমাধান করে দেন। নিজে আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা করেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাঁর চাচাতো ভাই খুলনা এলাকার সবচেয়ে বড় ঠিকাদার, তাই কাজ পান। এ ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব খাটানো হয় না।
ঠিকাদারির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিথার হত্যা: আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর খুলনা অঞ্চলের প্রভাবশালী নেতা ও যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি শহিদ ইকবাল ওরফে বিথার খুন হন। এ ঘটনায় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে এ পর্যন্ত ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের জবানবন্দি অনুযায়ী, মূলত ঠিকাদারি ব্যবসার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ নিতেই পরিকল্পিতভাবে বিথারকে খুন করা হয়েছে। আর এই খুনের পরিকল্পনাকারী হিসেবে নাম এসেছে স্থানীয় চার প্রভাবশালী নেতার।
ওই ১৫ জন ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এসব জবানবন্দিতে বিথার হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাকারী হিসেবে কাজী আমিনুল হক, মিজানুর রহমান, আনিসুর রহমান পপলু ও সাইফুল ইসলামের নাম রয়েছে।
এসব জবানবন্দি ও খুলনা মহানগর পুলিশের প্রাথমিক তদন্ত অনুযায়ী, খুলনা আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ শীর্ষস্থানীয় নেতা ঠিকাদারি কাজ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বিথারকে বাধা মনে করতেন।
খুলনার মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি তালুকদার আবদুল খালেকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে বিথার ঠিকাদারি ব্যবসা শুরু করেন। বিথার খুন হওয়ার পর মেয়র খালেক একাধিকবার সংবাদ সম্মেলন করে এ হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়েছেন।
তালুকদার আবদুল খালেক এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিথার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হিসেবে জবানবন্দিতে যাঁদের নাম এসেছে, তাঁদের বিচার চাই। খুনিরা যে দলেরই হোক বিচার করতে হবে।’
খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি কাজী আমিনুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিথার আমাদের ছোট ভাই। তার ব্যবসা ছিল আলাদা, আমারটাও আলাদা। ফলে তার সঙ্গে আমার কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না। খুনের পরিকল্পনা করার তো প্রশ্নই আসে না।’
আসামিদের জবানবন্দি অনুযায়ী, ঠিকাদারি কাজের ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্বের অংশ হিসেবে বিথারকে খুন করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। ২০০৯ সালের ১১ জুন রাতে বিথার খুন হওয়ার পর যুবলীগ নেতা মেসবাহ হোসেইন ওরফে বুরুজসহ ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে সবে কাদির নামের এক আসামি ছাড়া সবাই জামিনে ছাড়া পেয়েছেন।
খুনের পরিকল্পনাকারী হিসেবে প্রভাবশালী নেতাদের নাম আসায় মামলাটি চাঞ্চল্যকর মামলা হিসেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ শাখায় পাঠানো হয়েছে। খুলনার বিভাগীয় পুলিশ কমিশনার শফিকুর রহমান বলেন, মামলাটির তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ শাখার অনুমোদন পেলেই অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।
আনিসুর রহমান ওরফে পপলু বলেন, ‘খুলনায় কোনো একটা অঘটন হলেই লোকে আমার নাম বলে। কিন্তু বিশ্বাস করেন, জীবনে আমি কাউকে একটা চড় পর্যন্ত দেই নাই। খুনের নির্দেশ দেওয়া তো দূরের কথা।’
বিথার হত্যার আসামিদের জবানবন্দিতে আপনার নাম কেন এল, জানতে চাইলে সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমরাও বিথার হত্যার বিচার চাই। পুলিশ যদি তদন্ত করে আমার নিজের নামও পায়। তাহলেও যাতে দ্রুত অভিযোগপত্র দেয়।’

জবানবন্দিতে বড় নেতাদের নাম
বিথার হত্যাকাণ্ডে গ্রেপ্তার হওয়া ইকরাম হোসেন গিয়াস জবানবন্দি দেন ২০০৯ সালের ১৯ আগস্ট। এতে তিনি বলেন, ‘আকাশ আমাকে বলে, দ্যাখ, একটা কাজ পেয়েছি, থাকতে হবে। কী কাজ আমি জিজ্ঞেস করলে আকাশ বলে, আমাকে আমিন কাজী, মিজান সাহেব, পপলু ও বুরুজ ডেকে নিয়ে বিথারকে মেরে ফেলার কাজ দিয়েছে। এ বিষয়ে আমিন কাজীর বাসায় মিটিং হয়েছে। আমি বলি, লোকটা ভালো, মারব কেন? তখন আকাশ বলে, নেতাদের বিভিন্ন কাজে বিথার সমস্যা করছে, তা ছাড়া কাজটি করতে পারলে ছয়-সাত লাখ টাকা পাওয়া যাবে।’
বিথার হত্যার অপর আসামি আতাউরের জবানবন্দিতে বলা হয়, ‘বিথার হত্যার কয়েক দিন আগে পপলু ভাই আমাকে ফোন করে খুলনায় আসতে বলে। আমি তিন দিন পর খুলনায় আসি। শিববাড়ী জিয়া হলের পাশে পপলু ভাইয়ের সঙ্গে আমার দেখা হয়। সেখানে অ্যাডভোকেট সাইফুল ছিল। পপলু ভাই আমাকে বলে, বিথার মেলা বাড়াবাড়ি করতেছে। ওর কারণে আমরা বাণিজ্য মেলার কাজ পেলাম না, কোথাও কোনো টেন্ডারের কাজ পাইছি না। ওকে মেরে ফেলতে পারলে আমরা ঠিকমতো কাজ পাব। আমি পপলু ভাইকে বলি, তাতে আমার কী লাভ। তখন পপলু ভাই বলে, তুই তো থানার লিস্টেড আসামি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করে তোর নাম কাটায় দেব, তোকে ঠিকাদারি কাজ দেব। পপলু ভাই কোনো কাজ দিলে আমি সেটা করি। আমি দুই-তিন দিন পর জানাব বলে চলে যাই। আমাকে পপলু ভাই দুই-তিন দিন পর আবার সংবাদ দেয়। আমি তাঁকে জানাই, আমাদের কোনো সমস্যা হলে কে দেখবে। তখন পপলু ভাই আমাকে জানায়, আমাদের সাথে আমিন কাজী, মিজান ভাই, বুরুজ, সাইফুল ভাই আছে। কোনো সমস্যা হলে আমরা দেখব। তখন আমি পপলু ভাইকে বলি, লোকজন ঠিক করতেছি। এর দু-এক দিন পর মিজান ভাই আমার কাছে ফোন করে জানতে চায়, পপলু ভাই তোকে কিছু বলেছে? পপলু ভাই যে কাজটার কথা বলেছে ওটা করে দে। আমি মিজান ভাইয়ের কাছে টাকা-পয়সার কথা জিজ্ঞেস করলে বলে যে বুরুজ ও পপলু ভাই টাকা-পয়সার বিষয়টা দেখবে। তারপর রাজু ও আকাশকে ঠিক করে দিই এবং তাদের বলি, পপলু ভাই তোদের দেখা করতে বলেছে, কাজ আছে।’

0 comments:

Post a Comment

Twitter Delicious Facebook Digg Stumbleupon Favorites More