আন্তর্জাতিক নানা ঘটনায় ঘটনাবহুল ছিল ২০১১ সালটি। আরব বসন্ত নামে যে
গণজাগরণ শুরু হয় তার ঢেউ লাগে আরববিশ্ব ছাড়িয়ে বিশ্বজুড়ে। যুক্তরাষ্ট্রে
শুরু হয় ওয়াল স্ট্রিটবিরোধী আন্দোলন।
পরবর্তীকালে অন্যান্য দেশেও পুঁজিবাদবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়। ওসামা বিন লাদেন হত্যা, জাপানের ভূমিকম্প ও সুনামিও ছিল আলোচনায়। এ ছাড়া বিশ্ব মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে দক্ষিণ সুদান নামে নতুন একটি রাষ্ট্রের। মানুষের মুখে মুখে থাকা বছরের আলোচিত কিছু ঘটনা নিয়ে সালতামামি।
তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্টের পলায়ন
২৩ বছর ক্ষমতায় থাকার পর এ বছরের ১৪ জানুয়ারি আন্দোলনের মুখে পদত্যাগে বাধ্য হন তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট বেন আলী। আরব বসন্তের প্রথম শিকার তিনি। প্রেসিডেন্ট বেন আলীর অত্যাচারে প্রতিবাদ জানাতে ২০১০ সালের ১৭ ডিসেম্বর নিজের শরীরে আগুন ধরিয়ে আত্মাহুতি দেন দেশটির সবজি বিক্রেতা মোহাম্মদ বুয়াজিজি। বুয়াজিজির প্রতিবাদ থেকেই ‘আরব বসন্ত’ নামে গণজাগরণের সূচনা। দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট বেন আলী। এরপর এই গণজাগরণের জোয়ার একে একে মিসর, লিবিয়া, ইয়েমেন, সিরিয়া ও বাহরাইনে ছড়িয়ে পড়ে।
আন্দোলনের মুখে হোসনি মোবারকের পদত্যাগ
গণ-অভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হওয়া আরব বিশ্বের দ্বিতীয় নেতা মিসরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক। এতে অবসান ঘটে দীর্ঘ ৩০ বছরের শাসনের। গণবিক্ষোভ শুরু হওয়ার কয়েক দিনের মাথায় সরকার ভেঙে দিয়ে ২৯ জানুয়ারি তানতাওয়িকে উপপ্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন মোবারক। কিন্তু এর পরও আন্দোলন থেমে থাকেনি। ১৮ দিন টানা আন্দোলনে চলতে থাকে। অবশেষে ১১ ফেব্রুয়ারি দিনব্যাপী লাখো মানুষের বিক্ষোভের মুখে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন মোবারক। কায়রোর প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ ছেড়ে যান তিনি। কায়রোর তাহেরির স্কয়ারে উল্লাসে ফেটে পড়ে বিক্ষোভকারীরা।
মোবারকের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি মিসরে স্বৈরশাসন চালিয়েছেন দীর্ঘ ৩০ বছর। এই পুরো সময়ই তিনি জারি করে রাখেন জরুরি অবস্থা, নিষিদ্ধ করেছেন বিরোধী সব রাজনৈতিক দল। গড়ে তোলেনে অবৈধ সম্পদের পাহাড়।
প্রেসিডেন্ট সালেহর ক্ষমতার অবসান
ইয়েমেনে প্রায় ৩৩ বছর ধরে ক্ষমতাসীন ছিলেন প্রেসিডেন্ট আলী আবদুল্লাহ সালেহ। তাঁকে হটানোর দাবিতে গত জানুয়ারিতে আন্দোলন শুরু হয়। দেশটির পার্লামেন্টর বিরোধী জোট দ্য কমন ফোরাম প্রেসিডেন্ট সালেহর নিপীড়ন, জুলুম আর দুর্নীতির অভিযোগ এনে এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়।
আন্দোলনের মুখে গত ২৩ নভেম্বর প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যস্থতায় শর্তসাপেক্ষে ক্ষমতা ছাড়তে রাজি হন প্রেসিডেন্ট সালেহ। চুক্তি অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট সালেহ ভাইস প্রেসিডেন্ট আবদ্রবুহ মানসুর হাদির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। মধ্যপ্রাচ্যের চতুর্থ শাসক হিসেবে গণদাবির মুখে পদ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন তিনি। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতা ছাড়েননি। দেশটিতে সম্প্রতি জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠিত হয়েছে।
সালেহ-বিরোধী আন্দোলনের সময় সালেহর বাহিনীর দমন পীড়নে অনেক বিক্ষোভকারী নিহত হয়। ইয়েমেনে শান্তি প্রতিষ্ঠায় আন্দোলনের জন্য এ বছর শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন তাওয়াক্কুল কারমেল। নতুন বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি দেশটির নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
গৃহযুদ্ধের হুমকিতে সিরিয়া
জাতিসংঘের তথ্যমতে, আট মাস ধরে চলা এই আসাদ-বিরোধী আন্দোলনে সরকারি বাহিনীর হাতে নিহত ব্যক্তির সংখ্যা তিন হাজার ছাড়িয়ে গেছে। যদিও সিরিয়ার সরকারের দাবি, তাদের এক হাজার ১০০ নিরাপত্তাকর্মী নিহত হয়েছে।
সিরিয়ায় অধিকার প্রতিষ্ঠার এ আন্দোলন দেশটিতে গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা জাগিয়ে তুলেছে। সিরিয়ায় চলমান দমন-পীড়ন এবং হত্যাযজ্ঞের ফলে দেশটি পূর্ণমাত্রায় গৃহযুদ্ধের দিকে মোড় নিচ্ছে। ক্রমেই সশস্ত্র সংগ্রামের দিকে ধাবিত হচ্ছে এ আন্দোলন। আন্দোলনকারীরা এখন বিক্ষোভের পরিবর্তে প্রেসিডেন্ট আল-আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে অংশ নিতে হন্য হয়ে অস্ত্র খুঁজছে। অন্যদিকে সপক্ষ ত্যাগ করা বিদ্রোহী সেনারাও বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। এর মধ্যেই অনেক নিরাপত্তাকর্মী সপক্ষ ত্যাগ করেছেন। আসাদের অনুগত বাহিনী সপক্ষ ত্যাগ করে বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দেওয়ায় দেশটির পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করেছে।
ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যু
গত ২ মে পাকিস্তানে মার্কিন সশস্ত্র বাহিনীর একটি চৌকস দল মাত্র ৪০ মিনিটের অভিযানে হত্যা করে ওসামা বিন লাদেনকে। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে সন্ত্রাসী হামলায় ধসে পড়ে যুক্তরাষ্ট্রের গর্বের প্রতীক নিউইয়র্কের বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র। এ ঘটনার পরই ওসামা হয়ে ওঠেন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় শত্রু। এরপর ১০ বছর লাদেনের টিকিটিও ছুঁতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র।
মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারি এড়িয়ে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদ থেকে ৬০ কিলোমিটার উত্তরে অ্যাবোটাবাদের বিশাল একটি বাড়িতে বসবাস করতেন তিনি। বাড়িটি থেকে কয়েক গজ দূরে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি। আশপাশের বাড়িগুলোতে থাকেন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তারা। তিনতলা বাড়িটির চারপাশে ১০ থেকে ১২ ফুট উচ্চতার সীমানা প্রাচীর।
গোপন সূত্রের কাছে খবর পেয়ে লাদেনের অবস্থানের ব্যাপারে তদন্ত শুরু করেন মার্কিন গোয়েন্দা বাহিনী। লাদেনের অবস্থান নিশ্চিত হওয়ার পর পরিকল্পনা অনুযায়ী গত ২ মে পাকিস্তানের স্থানীয় সময় রাত পৌনে দুইটার দিকে ওই বাড়িতে অভিযান চালায় মার্কিন নেভি সিলের ছোট্ট একটি দল। চারটি হেলিকপ্টার নিয়ে সেখানে তারা অবতরণ করে। এরপর মার্কিন বাহিনী ঢুকে পড়ে বাড়িটির নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে। মার্কিন কর্তৃপক্ষের দাবি অনুযায়ী, লাদেন ও তাঁর সঙ্গীরা গুলি ছোড়ে মার্কিন সেনাদের লক্ষ্য করে। ৪০ মিনিটের মতো দুই পক্ষে গোলাগুলি চলে। এতেই নিহত হন যুক্তরাষ্ট্রের আতঙ্ক আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেন। মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান তিনি।
শেষ পর্যন্ত লাদেনকে হত্যার মাধ্যমে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অবসান ঘটায় যুক্তরাষ্ট্র। লাদেনকে হত্যার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভাষ্য ছিল—ন্যায়বিচার করেছে তারা। অন্যদিকে লাদেনের মৃত্যু সত্ত্বেও লড়াই চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করে আল-কায়েদা।
ভূমিকম্প ও সুনামিতে বিধ্বস্ত জাপান
১১ মার্চ আঘাত হানা প্রচণ্ড ভূমিকম্পের মধ্যে দিয়ে শুরু হয়েছিল জাপানের সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে ভয়াবহ সংকট। ভূমিকম্পের আঘাতে হতবিহ্বল মানুষ দুর্যোগের ব্যাপকতা বুঝে ওঠার আগেই সুনামির ঢেউ, ভাসিয়ে নিয়ে যায় বাড়িঘর, গাছপালা, যানবাহন, দৈনন্দিন ব্যবহারের নানা জিনিসপত্রসহ উপকূল এলাকায় বসবাসরত কয়েক হাজার নারী-পুরুষ আর শিশুকে। ক্ষয়ক্ষতির দিক থেকে সুনামির ব্যাপকতা ছিল ভূমিকম্পের চেয়েও অনেক বেশি।
জাপানে উত্তর-পূর্ব উপকূলে স্মরণকালের শক্তিশালী নয় দশমিক এক মাত্রার ভূমিকম্পের পর আঘাত হানে ভয়াবহ সুনামি। এ সময় প্রায় ৩৩ ফুট উচ্চতার ঢেউয়ে তছনছ হয়ে যায় উপকূলীয় অঞ্চল। ফুকুশিমা-১, ফুকুশিমা-২ পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্রে বিস্ফোরণে বেশ কয়েকটি চুল্লিতে আগুন ধরে যায়। এর ফলে তেজস্ক্রিয়াতা ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন এলাকায় । মোট ২০ হাজারের মতো মানুষ মারা যায় এ দুর্যোগে।
জাপানের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংস্থার হিসাব মতে, ভূমিকম্প ও সুনামিতে আংশিক ও সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত ঘর-বাড়ির সংখ্যা ছিল প্রায় ৬৩ হাজার। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় মিয়াগি, ফুকুশিমা, ইওয়াতে অঞ্চলে। বিদ্যুত্হীন হয়ে পড়ে ২০ লাখ ঘর-বাড়ি।
লৌহমানব গাদ্দাফির মৃত্যু
৪২ বছর দেশ শাসনের পর ২০ অক্টোবর বিদ্রোহীদের গুলিতে নিহত হন লিবিয়ার লৌহমানব কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফি। ক্ষমতা ছাড়তে রাজি না হওয়ায় এ বছরের ২০ মার্চ গাদ্দাফি-শাসিত লিবিয়ায় হামলা চালায় ন্যাটো বাহিনী। তবে পিছু না হটে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘আমি যোদ্ধা, লড়তে লড়তে যুদ্ধ ক্ষেত্রেই মরতে চাই।’ শেষ পর্যন্ত যুদ্ধরত অবস্থায় মারা যান তিনি।
১৯৬৯ সালে রক্তপাতহীন একটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশের ক্ষমতা দখল করেন সেনাবাহিনীর তত্কালীন ক্যাপ্টেন মুয়াম্মার গাদ্দাফি। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ২৭ বছর। ক্রমে সমাজতন্ত্র ও ইসলামি আদর্শের মিশেলে এক নিজস্ব রাজনৈতিক মতবাদ গড়ে তোলেন তিনি। টানা ৪২ বছর শাসন করেন গাদ্দাফি। এ বছরের প্রথম দিকে আরব বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো লিবিয়ায়ও সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। কয়েক মাসের আন্দোলন ও সশস্ত্র যুদ্ধের পর অবশেষে গত ২৩ আগস্ট ত্রিপোলির পতন ঘটে। এরপর আত্মগোপনে চলে যান ৬৯ বছর বয়সী গাদ্দাফি। এ বছরের ২০ অক্টোবর তাঁর অনুগত বাহিনীসহ গাড়িবহর নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর গাড়িবহরে বিমান হামলা চালায় ন্যাটো বাহিনী। এ সময় তিনি মারা যান। কিন্তু কীভাবে কিংবা কার হাতে তিনি মারা যান, সে বিষয় নিয়ে এখনো বিতর্ক রয়েছে। মৃত্যুর পর গোপন স্থানে তাঁর লাশ দাফন করা হয়।
দক্ষিণ সুদানের স্বাধীনতা লাভ
গত ৯ জুলাই পৃথিবীর বুকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে জন্ম নেয় দক্ষিণ সুদান। ১৯৩তম স্বাধীন দেশ হিসেবে জাতিসংঘের স্বীকৃতি লাভ করে দেশটি। দেশটির আয়তন দুই লাখ ৩৯ হাজার ২৮৫ মাইল। রাজধানী জুবা। দেশটির সরকারি ভাষা ইংরেজি। এ ছাড়া জুবার আশপাশে ‘জুবা আরবি’ ভাষা প্রচলিত। দেশটির মুদ্রা সুদানি পাউন্ড। দেশটির ২০০৮ সালের আদমশুমারি তথ্য অনুযায়ী দক্ষিণ সুদানের জনসংখ্যা ৮২ লাখ ৬০ হাজার ৪৯০ জন। জুবা দেশটির সবচেয়ে বড় শহর।
কয়েক দশক ধরে উত্তরের সঙ্গে গৃহযুদ্ধ চলে দক্ষিণ সুদানের। ২০০৫ সালে শান্তি চুক্তিতে সই করে দক্ষিণ সুদান। এরপর ২০০৫ সালের ৯ জুলাই স্বায়ত্তশাসন লাভ করে। দেশটির পূর্বে ইথিওপিয়া, দক্ষিণে কেনিয়া, উগান্ডা ও কঙ্গো। পশ্চিমে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকান ও উত্তরে সুদান। দক্ষিণ সুদানের অর্থনীতি বর্তমানে অনেকাংশে তেলের ওপর নির্ভরশীল। অবিভক্ত সুদানের ৭৫ শতাংশ তেলের মজুদই দক্ষিণ সুদানে আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ছাড়া দেশটি আন্তর্জাতিক বাজারে কাঠ রপ্তানি করে থাকে। prothom-alo
পরবর্তীকালে অন্যান্য দেশেও পুঁজিবাদবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়। ওসামা বিন লাদেন হত্যা, জাপানের ভূমিকম্প ও সুনামিও ছিল আলোচনায়। এ ছাড়া বিশ্ব মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে দক্ষিণ সুদান নামে নতুন একটি রাষ্ট্রের। মানুষের মুখে মুখে থাকা বছরের আলোচিত কিছু ঘটনা নিয়ে সালতামামি।
তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্টের পলায়ন
২৩ বছর ক্ষমতায় থাকার পর এ বছরের ১৪ জানুয়ারি আন্দোলনের মুখে পদত্যাগে বাধ্য হন তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট বেন আলী। আরব বসন্তের প্রথম শিকার তিনি। প্রেসিডেন্ট বেন আলীর অত্যাচারে প্রতিবাদ জানাতে ২০১০ সালের ১৭ ডিসেম্বর নিজের শরীরে আগুন ধরিয়ে আত্মাহুতি দেন দেশটির সবজি বিক্রেতা মোহাম্মদ বুয়াজিজি। বুয়াজিজির প্রতিবাদ থেকেই ‘আরব বসন্ত’ নামে গণজাগরণের সূচনা। দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট বেন আলী। এরপর এই গণজাগরণের জোয়ার একে একে মিসর, লিবিয়া, ইয়েমেন, সিরিয়া ও বাহরাইনে ছড়িয়ে পড়ে।
আন্দোলনের মুখে হোসনি মোবারকের পদত্যাগ
গণ-অভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হওয়া আরব বিশ্বের দ্বিতীয় নেতা মিসরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক। এতে অবসান ঘটে দীর্ঘ ৩০ বছরের শাসনের। গণবিক্ষোভ শুরু হওয়ার কয়েক দিনের মাথায় সরকার ভেঙে দিয়ে ২৯ জানুয়ারি তানতাওয়িকে উপপ্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন মোবারক। কিন্তু এর পরও আন্দোলন থেমে থাকেনি। ১৮ দিন টানা আন্দোলনে চলতে থাকে। অবশেষে ১১ ফেব্রুয়ারি দিনব্যাপী লাখো মানুষের বিক্ষোভের মুখে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন মোবারক। কায়রোর প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ ছেড়ে যান তিনি। কায়রোর তাহেরির স্কয়ারে উল্লাসে ফেটে পড়ে বিক্ষোভকারীরা।
মোবারকের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি মিসরে স্বৈরশাসন চালিয়েছেন দীর্ঘ ৩০ বছর। এই পুরো সময়ই তিনি জারি করে রাখেন জরুরি অবস্থা, নিষিদ্ধ করেছেন বিরোধী সব রাজনৈতিক দল। গড়ে তোলেনে অবৈধ সম্পদের পাহাড়।
প্রেসিডেন্ট সালেহর ক্ষমতার অবসান
ইয়েমেনে প্রায় ৩৩ বছর ধরে ক্ষমতাসীন ছিলেন প্রেসিডেন্ট আলী আবদুল্লাহ সালেহ। তাঁকে হটানোর দাবিতে গত জানুয়ারিতে আন্দোলন শুরু হয়। দেশটির পার্লামেন্টর বিরোধী জোট দ্য কমন ফোরাম প্রেসিডেন্ট সালেহর নিপীড়ন, জুলুম আর দুর্নীতির অভিযোগ এনে এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়।
আন্দোলনের মুখে গত ২৩ নভেম্বর প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যস্থতায় শর্তসাপেক্ষে ক্ষমতা ছাড়তে রাজি হন প্রেসিডেন্ট সালেহ। চুক্তি অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট সালেহ ভাইস প্রেসিডেন্ট আবদ্রবুহ মানসুর হাদির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। মধ্যপ্রাচ্যের চতুর্থ শাসক হিসেবে গণদাবির মুখে পদ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন তিনি। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতা ছাড়েননি। দেশটিতে সম্প্রতি জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠিত হয়েছে।
সালেহ-বিরোধী আন্দোলনের সময় সালেহর বাহিনীর দমন পীড়নে অনেক বিক্ষোভকারী নিহত হয়। ইয়েমেনে শান্তি প্রতিষ্ঠায় আন্দোলনের জন্য এ বছর শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন তাওয়াক্কুল কারমেল। নতুন বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি দেশটির নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
গৃহযুদ্ধের হুমকিতে সিরিয়া
জাতিসংঘের তথ্যমতে, আট মাস ধরে চলা এই আসাদ-বিরোধী আন্দোলনে সরকারি বাহিনীর হাতে নিহত ব্যক্তির সংখ্যা তিন হাজার ছাড়িয়ে গেছে। যদিও সিরিয়ার সরকারের দাবি, তাদের এক হাজার ১০০ নিরাপত্তাকর্মী নিহত হয়েছে।
সিরিয়ায় অধিকার প্রতিষ্ঠার এ আন্দোলন দেশটিতে গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা জাগিয়ে তুলেছে। সিরিয়ায় চলমান দমন-পীড়ন এবং হত্যাযজ্ঞের ফলে দেশটি পূর্ণমাত্রায় গৃহযুদ্ধের দিকে মোড় নিচ্ছে। ক্রমেই সশস্ত্র সংগ্রামের দিকে ধাবিত হচ্ছে এ আন্দোলন। আন্দোলনকারীরা এখন বিক্ষোভের পরিবর্তে প্রেসিডেন্ট আল-আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে অংশ নিতে হন্য হয়ে অস্ত্র খুঁজছে। অন্যদিকে সপক্ষ ত্যাগ করা বিদ্রোহী সেনারাও বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। এর মধ্যেই অনেক নিরাপত্তাকর্মী সপক্ষ ত্যাগ করেছেন। আসাদের অনুগত বাহিনী সপক্ষ ত্যাগ করে বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দেওয়ায় দেশটির পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করেছে।
ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যু
গত ২ মে পাকিস্তানে মার্কিন সশস্ত্র বাহিনীর একটি চৌকস দল মাত্র ৪০ মিনিটের অভিযানে হত্যা করে ওসামা বিন লাদেনকে। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে সন্ত্রাসী হামলায় ধসে পড়ে যুক্তরাষ্ট্রের গর্বের প্রতীক নিউইয়র্কের বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র। এ ঘটনার পরই ওসামা হয়ে ওঠেন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় শত্রু। এরপর ১০ বছর লাদেনের টিকিটিও ছুঁতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র।
মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারি এড়িয়ে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদ থেকে ৬০ কিলোমিটার উত্তরে অ্যাবোটাবাদের বিশাল একটি বাড়িতে বসবাস করতেন তিনি। বাড়িটি থেকে কয়েক গজ দূরে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি। আশপাশের বাড়িগুলোতে থাকেন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তারা। তিনতলা বাড়িটির চারপাশে ১০ থেকে ১২ ফুট উচ্চতার সীমানা প্রাচীর।
গোপন সূত্রের কাছে খবর পেয়ে লাদেনের অবস্থানের ব্যাপারে তদন্ত শুরু করেন মার্কিন গোয়েন্দা বাহিনী। লাদেনের অবস্থান নিশ্চিত হওয়ার পর পরিকল্পনা অনুযায়ী গত ২ মে পাকিস্তানের স্থানীয় সময় রাত পৌনে দুইটার দিকে ওই বাড়িতে অভিযান চালায় মার্কিন নেভি সিলের ছোট্ট একটি দল। চারটি হেলিকপ্টার নিয়ে সেখানে তারা অবতরণ করে। এরপর মার্কিন বাহিনী ঢুকে পড়ে বাড়িটির নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে। মার্কিন কর্তৃপক্ষের দাবি অনুযায়ী, লাদেন ও তাঁর সঙ্গীরা গুলি ছোড়ে মার্কিন সেনাদের লক্ষ্য করে। ৪০ মিনিটের মতো দুই পক্ষে গোলাগুলি চলে। এতেই নিহত হন যুক্তরাষ্ট্রের আতঙ্ক আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেন। মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান তিনি।
শেষ পর্যন্ত লাদেনকে হত্যার মাধ্যমে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অবসান ঘটায় যুক্তরাষ্ট্র। লাদেনকে হত্যার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভাষ্য ছিল—ন্যায়বিচার করেছে তারা। অন্যদিকে লাদেনের মৃত্যু সত্ত্বেও লড়াই চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করে আল-কায়েদা।
ভূমিকম্প ও সুনামিতে বিধ্বস্ত জাপান
১১ মার্চ আঘাত হানা প্রচণ্ড ভূমিকম্পের মধ্যে দিয়ে শুরু হয়েছিল জাপানের সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে ভয়াবহ সংকট। ভূমিকম্পের আঘাতে হতবিহ্বল মানুষ দুর্যোগের ব্যাপকতা বুঝে ওঠার আগেই সুনামির ঢেউ, ভাসিয়ে নিয়ে যায় বাড়িঘর, গাছপালা, যানবাহন, দৈনন্দিন ব্যবহারের নানা জিনিসপত্রসহ উপকূল এলাকায় বসবাসরত কয়েক হাজার নারী-পুরুষ আর শিশুকে। ক্ষয়ক্ষতির দিক থেকে সুনামির ব্যাপকতা ছিল ভূমিকম্পের চেয়েও অনেক বেশি।
জাপানে উত্তর-পূর্ব উপকূলে স্মরণকালের শক্তিশালী নয় দশমিক এক মাত্রার ভূমিকম্পের পর আঘাত হানে ভয়াবহ সুনামি। এ সময় প্রায় ৩৩ ফুট উচ্চতার ঢেউয়ে তছনছ হয়ে যায় উপকূলীয় অঞ্চল। ফুকুশিমা-১, ফুকুশিমা-২ পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্রে বিস্ফোরণে বেশ কয়েকটি চুল্লিতে আগুন ধরে যায়। এর ফলে তেজস্ক্রিয়াতা ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন এলাকায় । মোট ২০ হাজারের মতো মানুষ মারা যায় এ দুর্যোগে।
জাপানের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংস্থার হিসাব মতে, ভূমিকম্প ও সুনামিতে আংশিক ও সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত ঘর-বাড়ির সংখ্যা ছিল প্রায় ৬৩ হাজার। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় মিয়াগি, ফুকুশিমা, ইওয়াতে অঞ্চলে। বিদ্যুত্হীন হয়ে পড়ে ২০ লাখ ঘর-বাড়ি।
লৌহমানব গাদ্দাফির মৃত্যু
৪২ বছর দেশ শাসনের পর ২০ অক্টোবর বিদ্রোহীদের গুলিতে নিহত হন লিবিয়ার লৌহমানব কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফি। ক্ষমতা ছাড়তে রাজি না হওয়ায় এ বছরের ২০ মার্চ গাদ্দাফি-শাসিত লিবিয়ায় হামলা চালায় ন্যাটো বাহিনী। তবে পিছু না হটে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘আমি যোদ্ধা, লড়তে লড়তে যুদ্ধ ক্ষেত্রেই মরতে চাই।’ শেষ পর্যন্ত যুদ্ধরত অবস্থায় মারা যান তিনি।
১৯৬৯ সালে রক্তপাতহীন একটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশের ক্ষমতা দখল করেন সেনাবাহিনীর তত্কালীন ক্যাপ্টেন মুয়াম্মার গাদ্দাফি। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ২৭ বছর। ক্রমে সমাজতন্ত্র ও ইসলামি আদর্শের মিশেলে এক নিজস্ব রাজনৈতিক মতবাদ গড়ে তোলেন তিনি। টানা ৪২ বছর শাসন করেন গাদ্দাফি। এ বছরের প্রথম দিকে আরব বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো লিবিয়ায়ও সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। কয়েক মাসের আন্দোলন ও সশস্ত্র যুদ্ধের পর অবশেষে গত ২৩ আগস্ট ত্রিপোলির পতন ঘটে। এরপর আত্মগোপনে চলে যান ৬৯ বছর বয়সী গাদ্দাফি। এ বছরের ২০ অক্টোবর তাঁর অনুগত বাহিনীসহ গাড়িবহর নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর গাড়িবহরে বিমান হামলা চালায় ন্যাটো বাহিনী। এ সময় তিনি মারা যান। কিন্তু কীভাবে কিংবা কার হাতে তিনি মারা যান, সে বিষয় নিয়ে এখনো বিতর্ক রয়েছে। মৃত্যুর পর গোপন স্থানে তাঁর লাশ দাফন করা হয়।
দক্ষিণ সুদানের স্বাধীনতা লাভ
গত ৯ জুলাই পৃথিবীর বুকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে জন্ম নেয় দক্ষিণ সুদান। ১৯৩তম স্বাধীন দেশ হিসেবে জাতিসংঘের স্বীকৃতি লাভ করে দেশটি। দেশটির আয়তন দুই লাখ ৩৯ হাজার ২৮৫ মাইল। রাজধানী জুবা। দেশটির সরকারি ভাষা ইংরেজি। এ ছাড়া জুবার আশপাশে ‘জুবা আরবি’ ভাষা প্রচলিত। দেশটির মুদ্রা সুদানি পাউন্ড। দেশটির ২০০৮ সালের আদমশুমারি তথ্য অনুযায়ী দক্ষিণ সুদানের জনসংখ্যা ৮২ লাখ ৬০ হাজার ৪৯০ জন। জুবা দেশটির সবচেয়ে বড় শহর।
কয়েক দশক ধরে উত্তরের সঙ্গে গৃহযুদ্ধ চলে দক্ষিণ সুদানের। ২০০৫ সালে শান্তি চুক্তিতে সই করে দক্ষিণ সুদান। এরপর ২০০৫ সালের ৯ জুলাই স্বায়ত্তশাসন লাভ করে। দেশটির পূর্বে ইথিওপিয়া, দক্ষিণে কেনিয়া, উগান্ডা ও কঙ্গো। পশ্চিমে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকান ও উত্তরে সুদান। দক্ষিণ সুদানের অর্থনীতি বর্তমানে অনেকাংশে তেলের ওপর নির্ভরশীল। অবিভক্ত সুদানের ৭৫ শতাংশ তেলের মজুদই দক্ষিণ সুদানে আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ছাড়া দেশটি আন্তর্জাতিক বাজারে কাঠ রপ্তানি করে থাকে। prothom-alo
0 comments:
Post a Comment